প্রকাশ: ০৮ জুলাই’ ২০২৫ । নিজস্ব প্রতিবেদক | আজকের খবর অনলাইন
বাংলাদেশে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, প্রতিবছর দেশে নতুন করে প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। অথচ এর বিপরীতে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনো কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। বিশেষ করে রেডিয়েশন থেরাপির মতো আধুনিক চিকিৎসা-পদ্ধতির ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়ে গেছে গভীর ও বিস্তৃতভাবে।
আধুনিক ক্যানসার চিকিৎসায় রেডিয়েশন থেরাপি একটি অপরিহার্য উপাদান। বিশ্বের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থায় ক্যানসার আক্রান্ত অন্তত ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ রোগী কোনো না কোনো পর্যায়ে এই থেরাপির আওতায় আসেন। এটি যেমন ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর, তেমনি ব্যথা উপশম ও জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় রেডিওথেরাপি এখনো একটি সীমিত ও অপ্রতুল চিকিৎসা সেবা হিসেবে বিবেচিত।
সরকারি-বেসরকারি মিলে বর্তমানে দেশে রয়েছে প্রায় ২৫টি লিনিয়ার অ্যাক্সিলারেটর মেশিন, যা রোগীর তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, প্রতিটি মেশিন দিনে ৩০ থেকে ৪০ জন রোগীর সেবা দেওয়ার উপযুক্ত হলেও বাংলাদেশে একেকটি মেশিনে প্রতিদিন গড়ে ৮০ থেকে ১০০ জন রোগীকে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন থেরাপির মান পড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করায় অনেক রোগীর ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ছে, বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি।
অনেকেই দীর্ঘসূত্রতা ও আর্থিক প্রতিবন্ধকতায় মাঝপথেই চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার অনেকে প্রথম পর্যায়ে সেবাই পান না। এতে করে ক্যানসার চিকিৎসা হয়ে উঠছে জীবন ও মৃত্যুর ব্যবধান গড়ে দেওয়া এক অসম লড়াই।
তবে কেবল যন্ত্রের সংখ্যা বাড়ালেই এই সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। জরুরি হয়ে পড়েছে প্রশিক্ষিত রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, দক্ষ মেডিকেল ফিজিসিস্ট ও টেকনোলজিস্ট এবং একটি সহানুভূতিশীল কেয়ার টিম গড়ে তোলা। পাশাপাশি প্রয়োজন একাধিক কৌশলগত পদক্ষেপ, যেগুলো শুধু ক্যানসার চিকিৎসাকে সহজলভ্য করবে না, বরং জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে করবে আরও শক্তিশালী।
প্রথমত, সরকার ও বেসরকারি খাতের যৌথ অংশীদারিত্বের (PPP) ভিত্তিতে রেডিওথেরাপি সেবা সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। দেশের অনেক বেসরকারি হাসপাতাল অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে রেডিওথেরাপি সেবা দিয়ে থাকলেও অধিকাংশ সাধারণ রোগীর নাগালের বাইরে সেসব খরচ। সরকার যদি নির্ধারিত কিছু বেসরকারি হাসপাতালে নির্দিষ্ট সংখ্যক রোগী পাঠিয়ে চিকিৎসার ব্যয় বহন করে, তাহলে চিকিৎসাসেবা একদিকে যেমন গতি পাবে, অন্যদিকে রোগীর ভোগান্তিও কমবে।
দ্বিতীয়ত, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ক্যানসার রোগীদের জন্য যে অনুদান প্রথা চালু আছে, সেটি যুগোপযোগী ও বাস্তবভিত্তিক করা জরুরি। বর্তমানে ৫০ হাজার টাকার সীমা বৃদ্ধির পাশাপাশি এই অর্থ সরাসরি হাসপাতালকে দেওয়ার ব্যবস্থা করলে হয়রানি কমবে এবং রোগীরা নিরবচ্ছিন্ন সেবা পাবেন।
তৃতীয়ত, প্রতিটি বিভাগীয় শহরে এবং সরকারি মেডিকেল কলেজে অন্তত একটি করে পূর্ণাঙ্গ রেডিওথেরাপি ইউনিট স্থাপন করা উচিত। এতে করে রাজধানীকেন্দ্রিক চাপ কমবে এবং সারা দেশে সেবার সমতা নিশ্চিত হবে।
এছাড়া, একটি জাতীয় রেডিওথেরাপি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করার এখনই সময়, যেখানে নিয়মিত প্রশিক্ষণ পাবেন অনকোলজিস্ট, মেডিকেল ফিজিসিস্ট, রেডিওথেরাপি টেকনোলজিস্ট ও নার্সরা। মানসম্পন্ন ক্যানসার চিকিৎসার জন্য একটি দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করাই হতে পারে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ক্যানসার চিকিৎসাকে ব্যয়ের হিসাবের বাইরে এনে একটি মানবিক ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। একজন কর্মক্ষম ব্যক্তি ক্যানসারে আক্রান্ত হলে শুধু তার জীবন নয়, তার পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা এবং দেশের উৎপাদনশীলতাও ঝুঁকিতে পড়ে। তাই ক্যানসার চিকিৎসায় বিনিয়োগ কোনো অপচয় নয়, বরং তা একটি টেকসই অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য।
এই সমগ্র উদ্যোগের কেন্দ্রে থাকা উচিত একটি শক্তিশালী ও বাস্তবভিত্তিক জাতীয় ক্যানসার নীতি (NCCP)। যেখানে থাকবে নির্ভরযোগ্য স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম (যেমন ব্রেস্ট, সার্ভিকাল ও কোলন ক্যানসারের), পর্যায়ক্রমিক রেফারেল পদ্ধতি, সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার কার্যকর সমন্বয় এবং সুনির্দিষ্ট বাজেট পরিকল্পনা।
আমরা আজ যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তা শুধু সংকট নয়, এক বড় সম্ভাবনার দ্বারও বটে। যদি আমরা এখনই বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, সমন্বিত পদক্ষেপ নেই এবং সরকারি সদিচ্ছার সঙ্গে বেসরকারি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারি—তবে আমরা ক্যানসার চিকিৎসায় একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারি।
স্বাস্থ্যকে ব্যয় নয়, জাতীয় সম্পদ হিসেবে ভাবার সময় এখনই। ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের একসঙ্গে এগোতেই হবে—আর তা শুরু হোক রেডিয়েশন থেরাপিকে কেন্দ্র করেই।