প্রকাশ: ১লা জুলাই, ২০২৫ | আজকের খবর ডেস্ক | আজকের খবর অনলাইন
স্বৈরাচারের পতন হয় আচমকা নয়, বরং এক নিরব প্রবাহে, যার স্রোত গড়ে ওঠে মানুষের মুখ বুজে সহ্য করার দিনগুলো পেরিয়ে এসে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক রূপান্তরও তেমনই এক অধ্যায়, যেখানে একটি অপ্রত্যাশিত উক্তি—”রাজাকারের নাতিপুতিরা কি চাকরি পাবে?”—এক বিশাল আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গে পরিণত হয়। ইতিহাস দেখিয়েছে, স্বৈরাচার যতই শক্তভাবে ক্ষমতার খুঁটি ধরে রাখার চেষ্টা করুক না কেন, এক সময় পতনের ফাঁকফোকর তৈরি হবেই—এ যেন সৃষ্টিকর্তারই এক নির্ধারিত ব্যবস্থা।
আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাইদী একসময় বলেছিলেন, “স্বৈরাচার তার পতনের সমস্ত ছিদ্র বন্ধ করে দেয়, কিন্তু অজান্তেই একটি ছিদ্র থেকেই যায়; আর সেই ছিদ্র দিয়েই পতন ঘটে।” আজ এই কথা যেন কালের আয়নায় সত্যি হয়ে ধরা দিল। শেখ হাসিনা দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে একক ক্ষমতার আসনে আসীন ছিলেন। প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে সংবাদ মাধ্যম—সবকিছু ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণে। এক সময় তা এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, যেখানে সাধারণ মানুষ তো বটেই, বিরোধীদলগুলোকেও প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছিল।
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিগুলো যখন ছিল নিঃশব্দ, নিষ্ক্রিয়, দমনপীড়নে পিষ্ট—ঠিক তখনই কিছু তরুণ ছাত্র গর্জে ওঠে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ব্যানারে। এমন এক সময়, যখন বিএনপির নয়াপল্টনের অফিসেই সভা করার সাহস ছিল না, জামায়াত শিবির গোপনে ঝটিকা মিছিল করত, সেখানে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাহসিকতার যে বীজ বপন করে, তা-ই পরিণত হয় এক গণজাগরণে।
এই আন্দোলন আর যাই হোক, শুধুমাত্র কোটা সংস্কার নিয়ে সীমাবদ্ধ ছিল না। এর মূল প্রেরণা ছিল একটি শব্দ—রাজাকার। প্রধানমন্ত্রীর একটি সাংবাদিক সম্মেলনে, এক সাংবাদিকের সরল প্রশ্নে শেখ হাসিনার যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও অবজ্ঞামূলক উত্তর—“রাজাকারের নাতিপুতিরা কি চাকরি পাবে?”—তা-ই বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ জ্বেলে দেয়। এই একটি শব্দ যেন জাতির হৃদয়ে বারুদের মতো বিস্ফোরিত হয়। যে মানুষটি এক সময় বিনা বিচারে “রাজাকার” বানিয়ে ফাঁসি দিয়েছেন, সেই শব্দই হয়ে উঠল তাঁর রাজনৈতিক পরিণতির কালো ছায়া।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ, ছাত্র ধর্মঘট, রাস্তা অবরোধ, প্রতিরোধ—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়, যেখানে সরকার যেন আর টিকেই থাকতে পারে না। কোনো নির্বাচনী রসদ, কোনো প্রশাসনিক চাপ, কিংবা কোনো বিদেশি সমর্থন দিয়েও ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে রাখা সম্ভব হয়নি। শেষমেশ, ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায়ে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী গোপনে দেশত্যাগ করেন—নিঃশব্দে, নিঃচিহ্নে।
এই ঘটনার মাধ্যমে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়—মানুষ চিরকাল অবিচার সহ্য করে না। ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই ফেরাউন, নমরুদের মতো শাসকও চিরস্থায়ী হতে পারেনি। যত কঠোর শাসনই হোক না কেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা নির্দিষ্ট সময় শেষে তার পতনের জন্য ব্যবস্থা করে দেন। তাঁর বিচার থেকে কেউই মুক্ত নয়। যারা ভাবেন এই দুনিয়াতেই তাদের শাস্তি শেষ, তারা ভুলে যান যে একদিন কেয়ামতের ময়দানে হিসাব হবে প্রতিটি অন্যায়ের।
তবে এখন প্রশ্ন একটাই—এই ইতিহাস থেকে আমরা কী শিখব? আগামী দিনে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসবেন, তাদের কাছে জাতির প্রত্যাশা থাকবে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে, ন্যায়, ইনসাফ এবং জনমানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা বজায় রেখে দেশ পরিচালনা করবেন। যেন এই দেশ আর কখনো একনায়কতন্ত্রের শাসনে আক্রান্ত না হয়। কারণ ক্ষমতা আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে, আর মানুষ তার পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে, ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।