প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৫ │ আজকের খবর ডেস্ক │ আজকের খবর অনলাইন
বাংলাদেশের ফেসবুক টাইমলাইনে কয়েক দিন ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক আবেগময় পোস্ট—“৪৪টা যুদ্ধবিমান! এটাই বাংলাদেশ।” খোঁজ নিলে দেখা যায়, পরিসংখ্যানটি একেবারে অমূলক নয়। ফ্লাইটগ্লোবালের World Air Forces 2025 পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশ বিমানবাহীনীর সক্রিয় যুদ্ধবিমান সংখ্যা ৪৪–৪৬ এর মধ্যে ঘোরাফেরা করছে; এর মধ্যে ৩৬টি চীনা নির্মিত এফ-৭ সিরিজ এবং আটটি রুশ উৎপাদিত মিগ-২৯, যদিও ইঞ্জিনঘটিত জটিলতায় মিগের অর্ধেকই বর্তমানে মেরামতশালার আশ্রয়ে ।
চার দশক আগে নকশাকৃত এফ-৭ ফাইটার মূলত সোভিয়েত মিগ-২১-এর লাইসেন্স সংস্করণ; সীমিত রেঞ্জ ও পুরোনো অবকাঠামোর কারণে আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে এর টিকে থাকা কঠিন । মিগ-২৯ বহরের অবস্থাও উন্নত নয়—ইঞ্জিন ও রাডার আধুনিকায়নের অভাবে বর্তমানে কেবল তিনটি বিমানের পূর্ণ অপারেশনাল সক্ষমতা আছে, বাকি গুলোর সার্ভিস লাইফ বাড়াতে সম্প্রতি ৩০ মিলিয়ন ডলারের এক ইঞ্জিন-ওভারহল চুক্তি হয়েছে । ফলে কাগজে-কলমে ‘স্কোয়াড্রন’ থাকলেও আকাশে নিরবচ্ছিন্ন টহল দেওয়ার মত প্ল্যাটফর্ম হাতে নেই।
বিমানবাহিনীর পাশাপাশি সমন্বিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও বহু অংশে পুরোনো। চীনা উৎপাদিত ক্ষুদ্র-পাল্লার এফএম-৯০ SAM দুটি রেজিমেন্ট পর্যায়ে থাকলেও মাঝারি বা দীর্ঘ-পাল্লার ব্যালিস্টিক-প্রতিরোধে বাংলাদেশ এখনও প্রকৃত অর্থে সক্ষম নয় । পুরোনো পিএসআর-সিরিজ রাডারের জায়গা দখল করতে ইতালির লিওনার্দো ‘ক্ৰোনোস ল্যান্ড’ এবং ফ্রান্সের GM-403M মতো নতুন ৩-ডি AESA রাডার স্থাপন শুরু হয়েছে; তবে পূর্ণ জাতীয় কভারেজ পেতে কমপক্ষে আর দু-তিন বছর লাগবে বলে সামরিক সূত্র ।
বাংলাদেশের আশেপাশে meanwhile, আকাশযুদ্ধ সামর্থ্যে দ্রুত বদলে যাচ্ছে সমীকরণ। ফ্লাইটগ্লোবাল তথ্য বলছে, ২০২৫ সালে ভারতীয় বিমানবাহিনীর হাতে ৬১৬টি কমব্যাট এয়ারক্রাফট—রাফাল, সু-৩০এমকেআই, মিরেজ-২০০০ থেকে আগামী দশকের AMCA পঞ্চম-প্রজন্মের জেটের প্রস্তুতি flightglobal.com। ডিআরডিও-র হাইপারসনিক মিসাইল পরীক্ষাও শেষ ধাপে ।
অন্যদিকে পাকিস্তানের হাতে ৩৮৭ যুদ্ধবিমান; নতুন যোগ হয়েছে ২০টি জে-১০সি, জেএফ-১৭ ব্লক-৩ ও ৭৫টি এফ-১৬ । আন্তর্জাতিক কৌশলগত গবেষণা সংস্থা IISS-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে ইঙ্গিত রয়েছে, বৃহৎ রকেট মোটরের গবেষণার আড়ালে ইসলামাবাদ দীর্ঘ-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) উন্নয়নের পথ ধরেছে ।
চীনা সামরিক প্রযুক্তি তো আরও এক ধাপ এগিয়ে আছে—২০২৪ সালের শেষদিকে শেনিয়াং নির্মিত জে-৫০ ছয়-প্রজন্মের স্টেলথ ফাইটারের পরীক্ষামূলক অবতরণ ছবি প্রকাশ্যে আসে, যা এশীয় আকাশে নতুন শক্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে ।
এই বাস্তবতায় ২০০৯ সালে ঘোষিত Forces Goal 2030-এর অধীন তিন বাহিনীর যৌথ আধুনিকায়ন কর্মসূচি দ্রুতগতিতে এগোতে না পারলে বাংলাদেশের আকাশসীমা ঝুঁকিতে পড়বে—এ হুশিয়ারি দীর্ঘদিন ধরেই দিয়ে আসছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা । ফলে বিমানবাহিনী বর্তমানে অন্তত একটি “জেনারেশন লিপ” নিশ্চিতে ১৬টি জে-১০সি বিমান কেনার চুক্তি নিয়ে চীনের সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনায় আছে; উপসর্গ হিসেবে অ্যাক্টিভ E-সেক্টরেন্ড AESA রাডার ও PL-১৫ বি-ভিয়ার মিসাইল থাকায় এটি ৪.৫-শ্রেণির বহুমুখী ফাইটার হিসেবে বিবেচিত । পাশাপাশি ক্ষুদ্র-মাঝারি পাল্লার SAM সিস্টেম হিসেবে চীনের FM-৩০০০ বা FK-৩-এর একটি ব্যাটারি যোগ করার প্রক্রিয়াও সচল বলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র ।
সামরিক শক্তি কেবল যুদ্ধবিমান বা ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা দিয়ে বিচার করা হয় না—দায়িত্বশীল শৃঙ্খলা, গবেষণা-উন্নয়ন এবং পারদর্শী জনবলই যে কোনো প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মূল ভিত্তি। অথচ আমাদের সামাজিক পরিসরে “কী–বোর্ড ব্যাটালিয়ন” প্রতিদিন দুঃসাহসী স্ট্যাটাসে দেশপ্রেম জাহির করলেও বাস্তব শৃঙ্খলা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও পেশাদারিত্ব গড়ে তুলতে কালক্ষেপণ করি। ফলস্বরূপ প্রতিরক্ষা বাজেটের বড় অংশ গিয়ে ঠেকে ‘লাইফ-এস্কট’ বা জারজ প্রকল্পে; আধুনিক মেইনটেন্যান্স-ডকুমেন্টেশন ও সাইবার সুরক্ষার মতো ছাঁটাই-অদৃশ্য খাত বারবার অধরা থেকে যায়।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বিদ্যমান প্রজন্মের F-৭ ও মিগ-২৯ সম্ভবত ২০২৮ সালের মধ্যেই সম্পূর্ণ অবসরে যাবে। তার আগে অন্তত দুটি পূর্ণাঙ্গ মাল্টিরোল স্কোয়াড্রন, একটি মিডিয়াম-রেঞ্জ SAM রেজিমেন্ট, উন্নত নেটওয়ার্ক-কেন্দ্রিক রাডার-গ্রিড ও তিনটি EW/AEW&C প্ল্যাটফর্ম না এলে আকাশসীমা রক্ষায় চিরুনি অসামঞ্জস্য থেকেই যাবে। প্যারালেলে বেসামরিক বিমান চলাচল কতৃপক্ষ, নৌ ও স্থলবাহিনীর এয়ার-ডিফেন্স ইউনিট এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সেল মিলিয়ে ‘ইন্টিগ্রেটেড আকাশসীমা সচেতনতা কাঠামো’ তৈরির কাজ শুরু করাও জরুরি বলে তারা মত দেন।
প্রবীণ বিমানবাহিনী কর্মকর্তা এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মোহাম্মদ সাদিক আজকের খবরকে বলেন, “নৈতিক-আর্থিক জবাবদিহি এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার সমন্বয়ই প্রতিরক্ষা-ক্ষমতা বাড়ায়। রাজনৈতিক মতভেদ থাকতেই পারে, কিন্তু আকাশসীমা রক্ষার প্রশ্নে সর্বদলীয় ঐকমত্য ছাড়া সামনে এগোনো কঠিন।”
বাংলাদেশের জন্য তাই ‘স্বাধীন দেশে লজ্জা নয়, গর্ব’ দেখানোর উপায় একটাই—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ঢাল চাপা রেখে, তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া, প্রতিরক্ষা ব্যয়ের প্রতিটি পয়সায় স্বচ্ছতা আনা এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো। অন্যথায়, অতর্কিতে আকাশ কালো হলে পোস্ট দেওয়ার সুযোগ যেমন থাকবে না, তেমনি শোনার লোকও মিলবে না।
দেশরক্ষার লড়াই কেবল সীমান্তে নয়—কারখানায়, গবেষণাগারে, শ্রেণিকক্ষে; আর সেই লড়াইয়ে কোনো ‘কী-বোর্ড সুপারহিরো’ নয়, লাগবে পেশাদার সৈনিক ও বৈজ্ঞানিকদের নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রম। সোশ্যাল মিডিয়ার আলোড়ন যদি বাস্তব নীতি-পরিবর্তনে রূপ নিতে পারে, তবেই ৪৪-এর সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে আকাশে আশা জ্বলবে নতুন করে।