প্রকাশ: ৩০শে জুন ২০২৫ । নিজস্ব প্রতিবেদক
আজকের খবর অনলাইন
সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার পারদ যখন চরমে, তখন কূটনৈতিক আলাপের দরজা খোলা রাখার ইঙ্গিত দিয়েছে ইরান। তবে সেই আলোচনার শর্ত হিসেবে তেহরান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই ইরানের বিরুদ্ধে যেকোনো সামরিক হামলার পরিকল্পনা পরিত্যাগ করতে হবে। দেশটির উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাজিদ তাখত রাভানছি এই মন্তব্য করেন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে।
রাভানছি বলেন, “ট্রাম্প প্রশাসন পরোক্ষভাবে আমাদের কাছে বার্তা পাঠিয়েছে যে তারা আলোচনায় ফিরতে চায়। কিন্তু আমরা বলেছি, আলোচনার নামে যদি সামরিক হামলার ঝুঁকি বহাল থাকে, তাহলে কোনো ফলপ্রসূ সংলাপ সম্ভব নয়। আমেরিকাকে অবশ্যই তার আসল অভিপ্রায় পরিষ্কার করতে হবে।”
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যেভাবে সামরিক উত্তেজনা বেড়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। গত ১৩ জুন ইসরায়েল আকস্মিকভাবে ইরানের সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরান পাল্টা হামলায় জড়িয়ে পড়ে। ঠিক এর দুইদিন পর, ১৫ জুন ওমানের রাজধানী মাস্কাটে ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ষষ্ঠ দফা আলোচনার কথা থাকলেও তা বাতিল হয়ে যায়। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রও সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে এবং ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়।
তেহরানের অভিযোগ, এসব হামলা সরাসরি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং আলোচনা প্রক্রিয়াকে অকার্যকর করার কৌশল। রাভানছি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই আলোচনায় বসতে চায়, তাহলে তারা যেন সামরিক তৎপরতা বন্ধ রাখে, এটুকু নিশ্চয়তা চাইছি আমরা। একইসঙ্গে তারা যেন ইসরায়েলকেও লাগাম পরায়।”
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে তেল আবিবের অভিযোগ বহুদিনের। ইসরায়েল দাবি করে আসছে, তেহরান খুব শিগগিরই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে যাচ্ছে। এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন আখ্যা দিয়ে রাভানছি বলেন, “আমাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো সবসময়ই আমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়, এবং সেই কারণেই তারা এই কর্মসূচিকে ভয়ের হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা অনেক সময় আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম বা যন্ত্রপাতি পাইনি। ফলে নিজেদের স্বনির্ভরতা বাড়াতে বাধ্য হয়েছি। এর মানে এই নয় যে, আমরা বোমা তৈরি করছি বা করতে চাই।”
তবে ইসরায়েলের সামরিক তৎপরতা এরই মধ্যে ইরানে চরম ক্ষয়ক্ষতির জন্ম দিয়েছে। ইরানি সেনাবাহিনীর একাধিক উচ্চপদস্থ কমান্ডার, পরমাণু বিজ্ঞানী ও গবেষক বিভিন্ন সময় গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। দেশটির নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর দাবি, এসব হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ইসরায়েল, এবং যুক্তরাষ্ট্র তা মদদ দিয়ে আসছে।
বিশ্লেষকদের মতে, তেহরানের কূটনৈতিক অবস্থান এখন দ্বৈত পথে চলছে—একদিকে তারা আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষায় শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, অন্যদিকে বিশ্ব জনমতকে পাশে রাখতে চাচ্ছে শান্তিপূর্ণ আলোচনার সুযোগও তৈরি করতে। তবে এই আলোচনার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর।
মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাবস্থার ছায়া ক্রমেই ঘনিভূত হচ্ছে। যদি যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান আলোচনায় ফেরার পথ তৈরি না করে, তবে নতুন একটি সামরিক সংঘর্ষ শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। এমন বাস্তবতায় ইরানের পক্ষ থেকে আলোচনার শর্ত হিসেবে হামলা না করার নিশ্চয়তা চাওয়া কেবল রাজনৈতিক কৌশল নয়, এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার অন্যতম প্রধান নিয়ামক হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের মধ্যে, এই সংকট কতটা দ্রুত শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে মোড় নেবে, তা নির্ভর করছে আগামী কয়েক সপ্তাহের কূটনৈতিক অগ্রগতির ওপর। ইতোমধ্যে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও সংলাপ পুনরায় শুরু করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, যুক্তরাষ্ট্র তাদের পুরনো দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে কোনো গঠনমূলক পদক্ষেপ নেয় কিনা।