প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৫ | আজকের খবর ডেস্ক | আজকের খবর অনলাইন
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম জটিল ও বহু দশকের পুরোনো সংকট—ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিরোধ—নতুন করে উত্তেজনার মুখে পড়েছে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক বক্তব্যে। তিনি দৃঢ় ভাষায় বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের কখনোই স্বাধীন ও পূর্ণাঙ্গ সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের অনুমতি দেওয়া হবে না। এমনকি স্বশাসন থাকলেও, তাদের হাতে সার্বভৌম নিরাপত্তা ক্ষমতা কখনোই থাকবে না বলে তিনি স্পষ্ট করে দেন।
সোমবার (৭ জুলাই) যুক্তরাষ্ট্র সফরে হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে এসব মন্তব্য করেন নেতানিয়াহু। বৈঠকের মূল আলোচনার বিষয় ছিল গাজা উপত্যকার চলমান যুদ্ধবিরতি পরিস্থিতি ও হামাসের হাতে আটক থাকা ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির সম্ভাব্য চুক্তি। তবে আলোচনা যতই সমসাময়িক হোক না কেন, নেতানিয়াহুর বক্তব্য ছিল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির গভীর প্রতিফলন—যেখানে তিনি আবারও স্পষ্ট করলেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণা ইসরায়েলের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার বরাতে জানা যায়, নেতানিয়াহু বলেন, “ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব প্রশাসন চালানোর অধিকার থাকতে পারে, তবে কোনোভাবেই তারা এমন কোনো ক্ষমতা পাবে না যা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। সার্বভৌম নিরাপত্তা, সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ—এসব কিছুই থাকবে কেবলমাত্র ইসরায়েলের হাতে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা এমন এক শান্তি চাই, যেখানে ফিলিস্তিনিরা আমাদের ধ্বংসের চিন্তা করবে না। আমরা এমন এক বাস্তবতা গড়তে চাই, যেখানে শান্তি আসবে আমাদের হাতে নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ রেখে। এই কারণেই সার্বভৌমতার প্রশ্নে ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।”
সবচেয়ে জোরালো বক্তব্য আসে নেতানিয়াহুর পরবর্তী ঘোষণায়, যেখানে তিনি বলেন, “অনেকে বলবে, ‘এটা রাষ্ট্র নয়, এটা অর্ধেক রাষ্ট্র’—তাতে কিছু যায় আসে না। আমরা শপথ করেছি—আর কখনো নয়। এই আর কখনো নয় মানে এখনই, এই মুহূর্তেই। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আর কোনোদিন হবে না, হতে দেওয়া হবে না।”
নেতানিয়াহুর এমন বক্তব্য বৈশ্বিক কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। কারণ, জাতিসংঘসহ অধিকাংশ আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রাষ্ট্র ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে কথা বলে এসেছে। তবে ইসরায়েল বরাবরই দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে আসছে—‘দ্বি-রাষ্ট্র নীতি’ তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে, বিশেষ করে হামাসের মতো সংগঠনগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে যদি সার্বভৌমতা প্রতিষ্ঠা পায়।
বৈঠকের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, তিনি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র নিয়ে কী ভাবেন। জবাবে ট্রাম্প বলেন, “আমি জানি না।” তাঁর এই অস্পষ্ট জবাব আবারও ইঙ্গিত দেয় যে, মার্কিন প্রশাসনও বর্তমান সময়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আগ্রহী নয় বা স্পষ্ট অবস্থান নিতে চায় না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতানিয়াহুর এই মন্তব্য শুধু তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক আবহে নয়, বরং এটি তার দীর্ঘদিনের কৌশলেরই ধারাবাহিকতা। ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির পর থেকেই আন্তর্জাতিক মহলে দুই রাষ্ট্র সমাধানের ধারণা জনপ্রিয়তা পায়, যেখানে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী সরকারের অধীনে সেই পথ ক্রমেই সংকুচিত হয়েছে।
নেতানিয়াহুর বক্তব্য প্রমাণ করে, গাজার যুদ্ধবিরতি বা জিম্মি বিনিময় প্রসঙ্গ যতই আলোচনায় থাকুক না কেন, বৃহত্তর কূটনৈতিক কাঠামোতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পথ আরও দুর্গম হয়ে পড়ছে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এ ধরনের মন্তব্য শুধু মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়াকেই নয়, বরং বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের নীতিমালাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো নেতানিয়াহুর বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এটি এক ধরণের ঔপনিবেশিক মানসিকতা, যেখানে একটি জাতিকে চিরতরে রাষ্ট্রহীন রাখার পরিকল্পনা প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয়েছে।
ফিলিস্তিনিদের বহু প্রজন্ম ধরে যে স্বপ্ন—একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের, তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা এই ঘোষণার ভবিষ্যৎ কী হবে, তা সময়ই বলবে। তবে এটুকু নিশ্চিত যে, মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির পথ আরও ঘোলাটে হয়ে উঠছে নেতানিয়াহুর এই ‘শপথ’-এর মধ্য দিয়ে।