প্রকাশ: ৩০শে জুন ২০২৫ । নিজস্ব প্রতিবেদক
আজকের খবর অনলাইন
দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তানে গত কদিন ধরে চলমান টানা বৃষ্টি, আকস্মিক বন্যা এবং ভূমিধস পরিস্থিতিকে ক্রমশ ভয়াবহ করে তুলছে। সর্বশেষ সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এসব দুর্যোগে এখন পর্যন্ত ৪৫ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই শিশু ও নারী। পাকিস্তানের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (NDMA) জানিয়েছে, প্রাণহানির পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শত শত বসতবাড়ি, ভেঙে পড়েছে সড়ক ও সেতু, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বেশ কয়েকটি এলাকা।
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদন অনুসারে, সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে। আফগান সীমান্তঘেঁষা এই অঞ্চল বরাবরই দুর্যোগে বেশি বিপদাপন্ন থাকে, আর এবারের দুর্যোগ যেন তারই প্রমাণ। সেখানে ১০ শিশুসহ প্রাণ হারিয়েছেন ২১ জন। আকস্মিক বন্যার তোড়ে অনেকেই ভেসে গেছেন। বহু মানুষ এখনো নিখোঁজ এবং উদ্ধারকাজ এখনও চলছে।
এদিকে পাঞ্জাব প্রদেশেও পরিস্থিতি ভয়াবহ। দেওয়াল ধস ও ছাদের নিচে চাপা পড়ে প্রাণ গেছে ১৩ জনের, যাদের মধ্যে আটজনই শিশু। শহরাঞ্চলে জলাবদ্ধতা চরম আকার ধারণ করেছে। পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোরে রোববার ৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা চলমান মৌসুমি বর্ষার চিত্রকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে। অনেক এলাকার বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
সিন্ধু ও বেলুচিস্তান প্রদেশেও মৃত্যুর খবর এসেছে। উভয় প্রদেশে নিহতের সংখ্যা মিলিয়ে দাঁড়িয়েছে ১১ জনে। বেলুচিস্তানের কিছু প্রত্যন্ত এলাকায় সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানো চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
পাকিস্তানের আবহাওয়া অধিদপ্তর সতর্ক করে জানিয়েছে, এই দুর্যোগ তাত্ক্ষণিকভাবে থামছে না। আগামী শনিবার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে বলে পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে। এতে করে ভূমিধস, নদী ভাঙন এবং নতুন করে বন্যা দেখা দিতে পারে বলে শঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব এলাকা আগে থেকেই পানিতে নিমজ্জিত, সেখানে বিপদ আরও ঘনিয়ে আসছে।
এছাড়া পাকিস্তানে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঝড়বৃষ্টিতেও ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। গত মাসে এক দফা দুর্যোগে ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছিল, যা এখনকার পরিস্থিতির সঙ্গে মিলে দেশটিকে বারবার দুর্যোগের মুখোমুখি করে তুলছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও জলবায়ু গবেষকদের মতে, পাকিস্তান জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ অভিঘাতে পড়া একটি প্রধান ভুক্তভোগী দেশ। বিশ্বে কার্বন নিঃসরণে দেশটির ভূমিকা প্রায় নগণ্য হলেও দুর্যোগের মাত্রা সেখানে দ্রুত বাড়ছে। অনিয়মিত মৌসুমি বৃষ্টিপাত, দ্রুত তাপমাত্রা পরিবর্তন, গ্রীষ্মকালে হঠাৎ বরফ গলা এবং মেঘভাঙা বৃষ্টির সংখ্যা বৃদ্ধি — এসবই সংকেত দিচ্ছে যে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিকে আরও বড় জলবায়ু বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
বিপর্যয় মোকাবিলায় সেনাবাহিনী, বেসামরিক উদ্ধার বাহিনী এবং স্থানীয় প্রশাসন যৌথভাবে কাজ করছে। কয়েকটি জেলায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে এবং আশ্রয়শিবিরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বিপদাপন্ন পরিবারগুলোকে। খাদ্য ও পানীয় সংকট দেখা দেওয়ায় আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোও মাঠে নামতে শুরু করেছে।
মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশেষ করে শিশু ও নারীসংখ্যা যেভাবে প্রাণ হারাচ্ছে, তা আন্তর্জাতিক মহলেও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং রেডক্রস ইতিমধ্যে পাকিস্তানে জরুরি সহায়তা পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে।
দুর্যোগের এই ক্রমাগত চাপে পাকিস্তানের দুর্বল অবকাঠামো এবং স্বল্প প্রস্তুতির বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াই নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু অভিযোজন কৌশল গ্রহণ না করলে এ ধরনের বিপর্যয় ভবিষ্যতে আরও তীব্র ও ভয়াবহ হয়ে উঠবে।