প্রকাশ: ১৩ জুন, ২০২৫ • আজকের খবর অনলাইন
ভারতের আহমেদাবাদে ঘটে যাওয়া একটি ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা রাজস্থানের যোশী পরিবারকে চিরতরে বদলে দিয়েছে। বিমানবন্দরের ব্যস্ততা, ভবিষ্যতের স্বপ্ন আর এক নতুন জীবনের সম্ভাবনা—সবকিছু এক মুহূর্তেই থেমে গেল। সেই নির্দয় মুহূর্তটি এখন কেবল স্মৃতিতে বেঁচে আছে একটি মোবাইল ফোনে তোলা পারিবারিক সেলফির মাধ্যমে, যে সেলফি হয়তো আজ কোনো অচেনা ধ্বংসস্তূপে পড়ে আছে, হয়তো আর কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
১২ জুন বৃহস্পতিবার, রাজস্থানের উদয়পুর শহরের এক চিকিৎসক দম্পতি ডা. প্রতীক যোশী ও ডা. কমি ব্যাস তাদের তিন সন্তানকে নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার পরিকল্পনা করেছিলেন। আহমেদাবাদ বিমানবন্দর থেকে রওনা হয়ে তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটি নতুন জীবনের সূচনা, যেখানে পুরনো পেশাজীবন ছেড়ে শুরু হবে একটি ভিন্ন পথচলা। ডা. কমি ব্যাস, যিনি উদয়পুরের একটি হাসপাতালে গাইনিকোলজিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন, সম্প্রতি পদত্যাগ করেছিলেন, যাতে লন্ডনে তার স্বামীর সঙ্গে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে পারেন।
বিমানে ওঠার আগে, এয়ার ইন্ডিয়ার ৬৯ থেকে ৭৩ নম্বর সিটে বসে পরিবারের পাঁচ সদস্য একটি সেলফি তোলেন—সেই ছবিতে ছিলো শুধু হাসিমুখ, উচ্ছ্বাস আর একসঙ্গে ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ানোর আনন্দ। কমির পাশে বসা প্রতীক হাসছিলেন শান্তভাবে। তাদের দুই যমজ ছেলে নকুল ও প্রদ্যুৎ, যারা মাত্র পাঁচ বছর বয়সী, ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে নিষ্পাপ হাসি দিচ্ছিল, আর বড় মেয়ে আট বছর বয়সী মিরায়া যেন আনন্দে ফেটে পড়ছিল। এই মুহূর্তটাই রয়ে গেছে জীবনের শেষ পারিবারিক ছবি হিসেবে—একটি বিভীষিকাময় দিনকে সাক্ষ্য রেখে।
প্রতীক ও কমি দু’জনেই উদয়পুরের বিখ্যাত প্যাসিফিক হাসপাতালে কাজ করতেন। কিছুদিন আগে প্রতীক যুক্তরাজ্যে একটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে চাকরি পান এবং তারপর ভারত ফিরে আসেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যেতে। পরিবারটি আহমেদাবাদে আসে লন্ডনগামী ফ্লাইট ধরার উদ্দেশ্যে। তাদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের অনেকেই এসেছিলেন সেদিন বিদায় জানাতে। সেই প্রস্থানের দৃশ্য এখন শুধুই স্মৃতি। প্রতীকের আত্মীয় নয়ন জানিয়েছেন, তারা আহমেদাবাদে পৌঁছানোর পর বিমানবন্দর থেকে পরিবারের সঙ্গে শেষ দেখা করেন।
ডা. কমির ভাই প্রাবুদ্ধ জানিয়েছেন, প্রায় এক দশক আগে প্রতীক-কমির বিয়ে হয়। প্রতীকের বাবা ছিলেন একজন খ্যাতনামা রেডিওলজিস্ট, আর কমির বাবা সরকারি দপ্তর পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ছিলেন। প্রতীকের এক বোন আছেন, যিনি একজন প্রকৌশলী। পরিবারটি সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত ও সম্মানিত একটি পরিবার হিসেবে পরিচিত।
এই দুর্ঘটনা শুধু একটি পরিবারের নয়, বরং একটি স্বপ্ন, একটি সম্ভাবনার চূড়ান্ত অপমৃত্যু। লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে এমন এক আনন্দময় মুহূর্তে তোলা ছবিটি এখন যেন এক ভয়ানক ঘটনার নিরব সাক্ষী। ছবি তোলে যে স্মৃতি তৈরি হয়, তা হয়তো ভালো সময়ের সাক্ষ্য দেয়—কিন্তু এই সেলফি আজ হয়ে উঠেছে মর্মান্তিক একটি ঘটনার একমাত্র দৃশ্যমান স্মারক। যে ফোনে ছবিটি তোলা হয়েছিল, সেটি হয়তো আজ ধ্বংসাবশেষের নিচে পড়ে আছে—নীরব, নিস্তব্ধ, তবে চিরদিনের জন্য গল্প বলে যাচ্ছে এক প্রজন্মের হারিয়ে যাওয়া জীবনের।
এই দুর্ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দেয়, জীবন কতটা অনিশ্চিত। মুহূর্তের হাসি কত দ্রুত কান্নায় রূপ নিতে পারে। আর কতটা জরুরি প্রতিটি মুহূর্তকে ধারণ করা, ভালোবাসা দেওয়া ও বাঁচিয়ে রাখা। যোশী পরিবারের শেষ পারিবারিক ছবিটি আমাদের এই কথাটাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়।