প্রকাশ: ৩০শে জুন, ২০২৫ | নিজস্ব সংবাদদাতা | আজকের খবর অনলাইন
মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে আবারও ছড়িয়ে পড়ছে উত্তেজনার ছায়া। সাম্প্রতিক সময়ে ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে বিরোধ যে ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে, তার ইঙ্গিত মিলছে ইরানের সামরিক নেতাদের কণ্ঠে এবং সংঘর্ষের সর্বশেষ ঘটনাগুলিতে। বিশেষ করে ইরানের কুখ্যাত এভিন কারাগারে চালানো বিমান হামলায় বহু প্রাণহানির ঘটনা নতুন করে বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল আবদুর রহিম মুসাভির হুঁশিয়ারি আরও দুঃসংবাদ বহন করছে, যেখানে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “আবার হামলা হলে আমরা শক্তির সর্বোচ্চ প্রয়োগে জবাব দেব।”
তেহরান মনে করছে, তাদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড ইতোমধ্যেই সরাসরি আগ্রাসনের পর্যায়ে পৌঁছেছে। জেনারেল মুসাভি বলেন, “আমরা যুদ্ধ শুরু করিনি, তবে প্রতিপক্ষের প্রতিটি আগ্রাসনের জবাবে আমরা পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করেছি। আমাদের দৃঢ় সন্দেহ রয়েছে, ইসরায়েল এবং তাদের মিত্ররা যুদ্ধবিরতি ও শান্তিপূর্ণ সমাধানে আন্তরিক নয়। ফলে আবার যদি আক্রমণ হয়, তাহলে এবার জবাব হবে আগের চেয়ে অনেক বেশি তীব্র, অনেক বেশি সংঘাতমূলক।”
এই কঠিন অবস্থার মধ্যে ইরানের বিচার বিভাগ এক ভয়াবহ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাদের ভাষ্যমতে, সম্প্রতি তেহরানের এভিন কারাগারে চালানো একটি বিমান হামলায় অন্তত ৭১ জন বন্দি নিহত হয়েছেন। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ইসরায়েলি বাহিনীর চালানো এই হামলার লক্ষ্য ছিল বিশেষ রাজনৈতিক বন্দিদের একটি অংশ, যারা তেহরানের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য, এভিন কারাগার দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক বিরোধীদের আটকের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নজরে বিশেষভাবে চিহ্নিত একটি প্রতিষ্ঠান। সেখানে এমন হামলা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল।
এছাড়া, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA)-এর মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলায় ইরানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, ইরান অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই পুনরায় উচ্চ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। তাঁর এই মন্তব্য স্পষ্টতই পশ্চিমা বিশ্বকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। পারমাণবিক কার্যক্রমে ইরান যদি আরও অগ্রসর হয়, তাহলে সামগ্রিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে বলেই ধারণা।
অন্যদিকে, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর একের পর এক বোমা হামলায় মৃতের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি অভিযানে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৫৬ হাজার ৫০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ৩৩ হাজার ৪১৯ জন। শুধুমাত্র গত ২৪ ঘণ্টাতেই নিহত হয়েছেন আরও অন্তত ৮৫ জন, আহতের সংখ্যা ৩৬৫। এসব হামলায় শিশুরা এবং সাধারণ নাগরিকরাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নীরব থাকায় ফিলিস্তিনে মানবিক বিপর্যয় নতুন রূপ নিচ্ছে।
এই মুহূর্তে ইসরায়েল অভ্যন্তরীণভাবেও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে চলমান মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ স্থগিত করেছে ইসরায়েলি আদালত। জানা গেছে, নেতানিয়াহুর আইনজীবীরা মামলাটি স্থগিতের অনুরোধ করেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত অনুরোধের ভিত্তিতে। এই ঘটনার প্রভাব ইসরায়েলের বিচারব্যবস্থা ও রাজনীতিতে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে আশঙ্কা করা হচ্ছে, ইরান ও ইসরায়েল যদি উভয়ে একে অপরকে সামরিকভাবে মোকাবেলার প্রস্তুতি নেয়, তবে তা শুধু এই দুই দেশকেই নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। আরব বিশ্বের বেশ কয়েকটি শক্তিধর রাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ইরানের পক্ষে কূটনৈতিক বার্তা দিয়েছে, এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রকাশ করেছে। তুরস্ক, সিরিয়া ও কাতার এই সংঘাতময় পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ চেয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, “এই সংঘাত যদি এখনই বন্ধ না হয়, তাহলে এটি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বিস্তৃত হয়ে পড়বে এবং বহুপাক্ষিক সংঘর্ষ শুরু হবে।” তিনি সকল পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে আহ্বান জানান এবং যুদ্ধবিরতির শর্ত মেনে চলার জন্য জোরালোভাবে আহ্বান করেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যকার বৈরিতা বহু দশকের পুরনো, তবে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো এই বৈরিতাকে বাস্তব যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশেষ করে পারমাণবিক কার্যক্রম, রাজনৈতিক বন্দি নিধন এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় শক্তিগুলোর অবস্থান মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।