প্রকাশ: ১৭ই জুন ২০২৫ | আজকের খবর ডেস্ক | আজকের খবর অনলাইন
মধ্যপ্রাচ্য যখন ইসরাইল-ইরান উত্তেজনায় অগ্নিগর্ভ, ঠিক তখনই ঘটলো এমন এক বিস্ফোরণ যা শুধু একটি ভবন নয়, নড়ে দিয়েছে বহু দশকের বৈজ্ঞানিক ও কৌশলগত পরিকল্পনার ভিত। ইরানের এক প্রত্যাঘাতমূলক হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে ইসরাইলের অন্যতম গর্ব, ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স।
এই প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে সাধারণ মানুষের কল্পনায় যা স্থান পায়, বাস্তবতা তার চেয়েও অনেক বেশি জটিল। যেটিকে বাইরের দুনিয়া শুধু একাডেমিক গবেষণা কেন্দ্র বলে জানত, সেটি আদতে ছিল ইসরাইলের পরমাণু গবেষণা ও সামরিক প্রযুক্তির একটি ‘গভীর’ কেন্দ্র।
ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউটের যাত্রা শুরু ১৯৩৪ সালে। নামকরণ করা হয় চেইম ওয়েইজম্যানের নামে, যিনি শুধু এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা নন, বরং ইসরাইলের প্রথম রাষ্ট্রপতিও ছিলেন। পাশাপাশি তিনি ছিলেন জায়নিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। শুরুতে এটি ছিল মৌলিক বিজ্ঞানের চর্চা কেন্দ্র, কিন্তু কালের পরিক্রমায় এটি রূপ নেয় একটি প্রযুক্তি-সামরিক একীভূত প্ল্যাটফর্মে।
ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম এই ইনস্টিটিউটকে বারবার ‘টেকনোলজিক্যাল ব্যাকবোন’ এবং ‘কৌশলগত ভিত্তি’ বলে বর্ণনা করেছে। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা—প্রতিটি শাখায় এ প্রতিষ্ঠান সুনাম অর্জন করে। এখান থেকেই জন্ম নেয় বহু যুগান্তকারী আবিষ্কার, যার মধ্যে কিছু ছিল নিছক চিকিৎসা গবেষণা, আবার কিছু ছিল সরাসরি সামরিক প্রয়োগে উপযোগী।
এই ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা শুধু তাত্ত্বিক গবেষণায় সীমাবদ্ধ ছিলেন না—তারা জড়িত ছিলেন ইসরাইলি প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে। বিশেষ করে এলবিট সিস্টেমসের সঙ্গে তাদের যৌথ কাজ, বিভিন্ন ড্রোন প্রযুক্তি এবং স্মার্ট অস্ত্রব্যবস্থার বিকাশে, ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোচিত।
ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউট কেবল একাডেমিক প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটিই ইসরাইলের পারমাণবিক প্রযুক্তি উন্নয়নের পেছনে অন্যতম চালিকাশক্তি। ইনস্টিটিউটটির সঙ্গে যুক্ত ছিল নেগেভ মরুভূমিতে অবস্থিত গোপন পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র—ডিমোনা ফ্যাসিলিটি। এই কেন্দ্র বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিক নজরদারির বাইরে থেকে কাজ চালিয়ে আসছিল। এখানে শুধু গবেষণা নয়, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ধারণা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়া হতো বলেও একাধিক সূত্রে জানা যায়।
এখানেই ইরানের ক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু। গত এক দশকে একাধিক ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী রহস্যজনকভাবে নিহত হয়েছেন, যাদের পেছনে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। তেহরান বরাবরই অভিযোগ করে আসছিল যে, এসব হত্যাকাণ্ডের প্রযুক্তিগত সহায়তা ও পরিকল্পনা এসেছে ইসরাইলের এই গবেষণা কেন্দ্র থেকেই।
এখন ধারণা করা হচ্ছে, সেই দীর্ঘসূত্রিক প্রতিক্রিয়ারই পরিণতি হলো এই হামলা। ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউটকে লক্ষ্য করে পরিচালিত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নিছক প্রতীকী নয়—এটি ছিল প্রতিশোধের সরাসরি বার্তা।
যদিও পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো এবং কিছু ইসরাইলি কর্মকর্তা দাবি করছেন, হামলায় আংশিক ক্ষতি হয়েছে, তবুও স্যাটেলাইট ইমেজ এবং স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, পুরো ক্যাম্পাস ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং কয়েকটি বিশেষায়িত ল্যাব ধ্বংস হয়ে গেছে।
ইনস্টিটিউটের ভেতরে কর্মরত কয়েক হাজার বিজ্ঞানী, গবেষক ও শিক্ষার্থীদের অনেকেই আহত হয়েছেন বলে গুজব রটেছে, যদিও তা নিশ্চিত করা যায়নি। গবেষণা উপকরণ, সার্ভার, নিরাপদ তথ্যঘর এবং প্রযুক্তিগত কেন্দ্র—সবকিছুই এই হামলার ফলে স্থবির হয়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এই হামলা ইসরাইলের জন্য কেবল একটি সামরিক আঘাত নয়, বরং একটি প্রযুক্তিগত ধাক্কাও। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর সম্মিলিত সহযোগিতা নিয়েও ইসরাইলের প্রযুক্তি-নির্ভর প্রতিরক্ষা কাঠামোর এই ক্ষতি পূরণ করতে সময় লাগবে। একইসাথে এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক ধাক্কা, যা ইরান কৌশলে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে চায়।
এখন প্রশ্ন উঠছে—এই আঘাতের জবাবে ইসরাইল কী আরও বড় আকারে প্রতিক্রিয়া দেখাবে? নাকি যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি সংঘাতে নামাতে চাপে রাখবে?
ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউটের ধ্বংস কোনো সাধারণ বোমাবর্ষণের ঘটনা নয়। এটি একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিশোধের বিস্ফোরক প্রকাশ, যার পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, জটিলতা এবং সমীকরণ। ইসরায়েল ও ইরান—উভয়ের জন্যই এটি একটি টার্নিং পয়েন্ট। যুদ্ধ শুধু রণক্ষেত্রে নয়, এখন চলছে গবেষণাগারেও।
এখন প্রশ্ন একটাই—এই প্রযুক্তি ও জ্ঞানের যুদ্ধ শেষ কোথায় গিয়ে থামবে? আর কে থাকবে শেষ হাসির মালিক?