প্রকাশ: ১৫ই জুন ২০২৫ । আজকের খবর ডেস্ক | আজকের খবর অনলাইন
পৃথিবীর ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত বহু পুরনো। তবে সাম্প্রতিক এক হামলায় ইসরায়েল যেভাবে ইরানের অভ্যন্তরে একের পর এক নির্ভুল ও বিস্ময়কর আঘাত হেনেছে, তা শুধু সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, গোয়েন্দা জগতে এক যুগান্তকারী কৌশলের নিদর্শন হিসেবেও চিহ্নিত হচ্ছে।
ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাম্প্রতিক এই অভিযানের গভীর কৌশল, পূর্বপ্রস্তুতি ও প্রযুক্তিগত প্রয়োগ সম্পর্কে বিস্তৃত বিশ্লেষণ উঠে এসেছে, যা গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়েই নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
এই অভিযানের নাম “অপারেশন রাইজিং লায়ন”—নামের মধ্যেই আভাস ছিল এক ভয়ংকর প্রত্যাঘাতের।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েল একদিন বা এক সপ্তাহের পরিকল্পনায় এই অপারেশন চালায়নি। এর পেছনে ছিল এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নির্মিত এক বহুমাত্রিক গোয়েন্দা কাঠামো। মোসাদ বছরের পর বছর ধরে ইরানের ভেতরে গড়ে তোলে এক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক—যা পারমাণবিক স্থাপনা থেকে শুরু করে সামরিক ঘাঁটি, শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গোপন আবাস পর্যন্ত নজরদারির আওতায় নিয়ে আসে।
২০১৮ সালে মোসাদ যেভাবে তেহরানের একটি গোপন গুদাম থেকে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প ‘আমাদ প্রজেক্ট’-এর হাজার হাজার গোপন নথি চুরি করে, তা গোটা পৃথিবীকেই চমকে দিয়েছিল। এই নথিগুলো পরবর্তী অভিযানের কাঁচামাল হয়ে ওঠে।
ইরানের গোয়েন্দা সংস্থাকে বিভ্রান্ত করতে ইসরায়েল একটি সমান্তরাল প্রচারণা চালায়। একদিকে তারা বিশ্বমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় যে, ইসরায়েলের প্রধান রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা নেতারা ওয়াশিংটনে অবস্থান করছেন এবং গাজায় মানবাধিকার রক্ষার বিষয়ে আলোচনা চলছে। বাস্তবে এই সময়েই তেলআবিবের কেন্দ্র থেকে তারা ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’-এর সরাসরি কমান্ড দিচ্ছিলেন।
**বৃহস্পতিবার রাতে আয়োজিত ‘নিরাপত্তা ক্যাবিনেট বৈঠক’**কে তুলে ধরা হয় গাজায় জিম্মি মুক্তি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। অথচ আসলেই সেটি ছিল চূড়ান্ত সামরিক অভিযান অনুমোদনের সভা।
প্রতিবেদনের সবচেয়ে বিস্ময়কর অংশ ছিল ইসরায়েল কর্তৃক তেহরানের উপকণ্ঠে একটি গোপন ড্রোন ঘাঁটি স্থাপন করার তথ্য। এই ঘাঁটিতে রাখা হয় বিস্ফোরকবোঝাই কামিকাজে ড্রোন, যেগুলো রিমোট কন্ট্রোলে পরিচালিত হয়ে হামলার মুহূর্তে সক্রিয় করা হয়। এই ড্রোনগুলোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয় সাধারণ বেসামরিক অবকাঠামোর আড়ালে রেখে।
এগুলো সরাসরি ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার, এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং রাডার ঘাঁটিগুলিকে ধ্বংস করে দেয়। বেশ কিছু ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে—ড্রোনগুলো নির্দিষ্টভাবে টার্গেট হিট করে বিস্ফোরণ ঘটায় এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পুরো অঞ্চল অন্ধকারে ঢেকে যায়।
মোসাদ দীর্ঘ সময় ধরে ইরানের ভেতরে বেসামরিক গাড়িতে গোপন অস্ত্র মজুত করে রেখেছিল। এসব গাড়ি ইরানের শহরতলি, পার্কিং লট কিংবা রাস্তার ধারে দীর্ঘ সময় ধরে পড়ে ছিল। কিন্তু বাস্তবে তারা ছিল মোসাদের দূরবর্তী নির্দেশে নিয়ন্ত্রিত অস্ত্রধারী ইউনিট।
আক্রমণের মুহূর্তে এসব গাড়ি থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়, যা ইরানের সামরিক স্থাপনাগুলোর ওপর যুগপৎ আঘাত হানে।
মোসাদ শুধু শারীরিক হামলা চালায়নি। ইরানের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ভীত ও দিশেহারা করতে চালানো হয়েছে মনস্তাত্ত্বিক অভিযান। অনেক শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তা, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের স্ত্রীদের মোবাইলে পাঠানো হয়েছে হুমকিমূলক বার্তা। “আমরা জানি আপনারা কোথায় আছেন”—এই বার্তাই যথেষ্ট ছিল আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে।
ইরানি নেতৃত্ব এমন বার্তাকে হালকা ভাবে না নিয়ে নিরাপত্তাব্যবস্থা পুনর্গঠনের নির্দেশ দেন, কিন্তু ততক্ষণে ‘কাজ শেষ’।
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই হামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে ১০ জুন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপের পর। যদিও ট্রাম্প প্রশাসনে নেই, তথাপি তার সঙ্গে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ও আদর্শিক ঘনিষ্ঠতার কারণে এই সিদ্ধান্তে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক মদদ ছিল বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। একই রাতে ইসরায়েলের নিরাপত্তা ক্যাবিনেট সর্বসম্মতভাবে অপারেশনের অনুমোদন দেয়।
এই হামলার পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়া মিশ্র। পশ্চিমা শক্তিগুলো একে ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও চীন, রাশিয়া এবং মুসলিম দেশগুলোর বড় অংশ এটিকে ইরানের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন এবং আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার উৎস বলে নিন্দা জানিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের অভিযান একদিকে প্রযুক্তির অসাধারণ ব্যবহার হলেও, অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিকে আরও বিপজ্জনক ও জটিল করে তুলছে। একটি ভুল সিদ্ধান্ত অথবা প্রতিশোধের প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়তো পুরো অঞ্চলকে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে টেনে নিতে পারে।
‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামক এই অভিযান শুধু একটি হামলা নয়, এটি গোয়েন্দা, সাইবার, মনস্তাত্ত্বিক ও সামরিক কৌশলের এক অবিশ্বাস্য মিশেল। এটি বোঝায় যে, আধুনিক যুদ্ধে শুধু মাটি বা আকাশ দখল নয়—মানসিকতা, তথ্য ও কৌশলগত সময়জ্ঞানও হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
এখন প্রশ্ন হলো—এই হামলার জবাবে ইরান কী করবে? এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ব, বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলো, কিভাবে এই উত্তেজনার জবাব দেবে? হয়তো সময়ই বলবে, তবে এটুকু নিশ্চিত—মধ্যপ্রাচ্যে আর কিছুই আর আগের মতো থাকবে না।