শিরোনাম :
ইরানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে চায় ইসরায়েল: প্রতিবেদন তেহরানের হৃদয়ে অপারেশন: ইরানের গভীরে ইসরায়েলের নিখুঁত হামলার পেছনের গোয়েন্দা কৌশল উদ্ঘাটন হাইফা বন্দরে ইরানের হামলা: মোদির আদানি খাতায় ‘আগ্নেয়’ ক্ষতির হিসাব শুরু! ১৪ বছরের জর্জ স্টিন্নি: ইতিহাসের নৃশংস বিচারবিভাগীয় হত্যাকাণ্ড ইরান দাবি করল ১৩টি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত: যুদ্ধক্ষেত্রের পাল্টা ভারসাম্য না কি মধ্যপ্রাচ্যীয় ভূরাজনীতির নতুন মোড়? মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ-ভূমিতে ইরান-ইসরাইল সংঘর্ষ: কূটনৈতিক চাপ, সামরিক বাস্তবতা ও বাংলাদেশের করণীয় সিলেটে উপদেষ্টা বহর আটকে ক্ষুব্ধ জনতার বিক্ষোভ দেশে ফিরলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস তারেক রহমান ও অধ্যাপক ইউনূসের বৈঠক ঘিরে ভূরাজনৈতিক বার্তা: ভারতের ভূমিকা নিয়ে শঙ্কা ও আঞ্চলিক সমীকরণে নতুন মোড় ইরানের সেনাপতি বাঘেরির হত্যাকাণ্ড: মধ্যপ্রাচ্যে বিস্ফোরণমুখী উত্তেজনা, বিশ্ব কি বৃহৎ যুদ্ধে ধাবিত হচ্ছে?

ইরান দাবি করল ১৩টি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত: যুদ্ধক্ষেত্রের পাল্টা ভারসাম্য না কি মধ্যপ্রাচ্যীয় ভূরাজনীতির নতুন মোড়?

আজকের খবর ডেস্ক
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫
  • ১৯ বার

প্রকাশ: ১৪ই জুন ২০২৫ | আজকের খবর ডেস্ক | আজকের খবর অনলাইন

মাত্র কিছু সময় আগেই আলজাজিরা টেলিভিশনের খবরে ইরানের পক্ষ থেকে একটি বিস্ফোরক দাবি উঠে এসেছে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, বিগত এক ঘণ্টার মধ্যে ইরান ইসরায়েলের অন্তত ১০টি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। এই দাবি যদি সত্য হয়, তাহলে এ পর্যন্ত ইরান কর্তৃক ভূপাতিত ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ১৩-এ। এমন এক সময়ে, যখন মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে, এই ধরনের সংবাদ শুধু সামরিক অর্জনের বিবরণ নয়—বরং এক বৃহৎ কূটনৈতিক ও কৌশলগত সংঘর্ষের আলামত বহন করে।

ইসরায়েলি বিমানবাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম আধুনিক ও দক্ষ বাহিনী হিসেবে বিবেচিত। যুক্তরাষ্ট্রের F-15, F-16 এবং সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হওয়া অত্যাধুনিক F-35 ‘স্টেলথ’ যুদ্ধবিমান তাদের শত্রু দমন কৌশলে একটি বিপ্লব এনেছে। তাই এই পরিমাণ ক্ষয়, যদি ইরানের দাবি সত্য হয়, তা নিঃসন্দেহে ইসরায়েলের জন্য এক বড় ধাক্কা, এমনকি ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধের পর অন্যতম বড় সামরিক বিপর্যয় বলেও বিবেচিত হতে পারে।

যেসব বিমান ভূপাতিত হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে F-35 এর মতো স্টেলথ প্রযুক্তিনির্ভর বিমান থাকলে, প্রশ্ন উঠবে—ইরান কীভাবে এত উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলল? বিশ্লেষকদের মতে, ইরান তাদের রাশিয়ান S-300 এবং নিজস্ব উন্নত প্রযুক্তি Bavar-373 সিস্টেমের মাধ্যমে এ সক্ষমতা অর্জন করেছে। যদিও এসব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আগে নানা সীমাবদ্ধতার মুখে পড়েছে, এবারের যুদ্ধপ্রেক্ষাপটে সেগুলোর কার্যকারিতা নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে।

ইসরায়েল এমন একটি দেশ, যারা আঘাতের জবাবে চুপ করে বসে থাকার পক্ষে নয়। প্রতিরোধমূলক কৌশল—ডিটারেন্স—তাদের সামরিক নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। অতীতে দেখা গেছে, যখনই ইসরায়েল সামরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তখন তারা দ্রুত এবং কৌশলগতভাবে পাল্টা আঘাত হেনেছে। ফলে, ইরান যদি সত্যি এই পরিমাণ যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে থাকে, তাহলে খুব শীঘ্রই ইসরায়েলের পাল্টা প্রতিক্রিয়া আশা করা যায়—হয় সামরিক ঘাঁটিতে সরাসরি আক্রমণ, নয়তো সাইবার হামলার মাধ্যমে অবকাঠামো ভেঙে ফেলা।

ইসরায়েল ইতিপূর্বে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় Stuxnet-এর মতো সাইবার আক্রমণ চালিয়েছে, যার মাধ্যমে একাধিক পারমাণবিক প্রক্রিয়া ধীর করা হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবারও তারা ইরানের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, যোগাযোগ অবকাঠামো কিংবা প্রতিরক্ষা চেইনের ওপর ভয়াবহ সাইবার আগ্রাসন চালাতে পারে।

এছাড়াও, কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তার করার সুযোগকেও ইসরায়েল হাতছাড়া করবে না। আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা, জ্বালানি নিরাপত্তা, বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল ও শরণার্থী সমস্যা তুলে ধরে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্রদের সরাসরি সংঘর্ষে টেনে আনার চেষ্টা করবে। ইসরায়েল বুঝে গেছে, শুধুমাত্র ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ নয়, বরং সেই যুদ্ধকে বৈশ্বিকভাবে বৈধতা দিতেও একটি কূটনৈতিক সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে।

অন্যদিকে, ইরানও কৌশলে পিছিয়ে নেই। তারা বহুদিন ধরে ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ বা পরোক্ষ যুদ্ধকৌশল ব্যবহার করে যাচ্ছে—যেমন হেজবুল্লাহ, হামাস, হুতি মিলিশিয়াদের মাধ্যমে ইসরায়েল ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করে। বর্তমান সংঘর্ষে এই গোষ্ঠীগুলো আরও সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে, যা ইসরায়েলকে একাধিক ফ্রন্টে লড়াই করতে বাধ্য করবে। বিশেষ করে লেবাননে হেজবুল্লাহর রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্রের ওপর ইসরায়েলি আক্রমণ বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল।

এই ধরণের সামরিক ক্ষয় শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা ব্যর্থতা নয়—এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক আঘাতও। ইসরায়েলের মতো একটি প্রযুক্তিনির্ভর দেশের জন্য এ ধরণের ক্ষতি নেতৃত্বের দক্ষতা, গোয়েন্দা বিশ্লেষণ এবং কৌশলগত প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। তারা নিশ্চিতভাবেই অভ্যন্তরীণভাবে এই বিষয়টি তদন্ত করবে এবং কিভাবে তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় এই দুর্বলতা তৈরি হলো, তা পুনর্মূল্যায়ন করবে।

বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটেও এই সংঘর্ষ এক নতুন মাত্রা যোগ করছে। মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে ইরান যদি এই প্রমাণ দিতে পারে যে তারা ইসরায়েলের আধুনিক সামরিক ক্ষমতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে সক্ষম, তাহলে তা তাদের রাজনৈতিক মর্যাদা ও আঞ্চলিক নেতৃত্বের জায়গা আরও শক্ত করবে। এমন এক সময়ে, যখন সৌদি আরব ও অন্যান্য আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে এগোচ্ছে, তখন ইরান নিজেকে ‘প্রতিরোধের মুখপাত্র’ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইবে।

এই পরিস্থিতি পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যেও বিভাজন তৈরি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত ইসরায়েলের পাশে অবস্থান নেবে, কিন্তু সরাসরি যুদ্ধ জড়াতে চায় না। ইউরোপ, যারা জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভরশীল, হয়তো যুদ্ধ থামাতে কূটনৈতিক সমঝোতার পক্ষে সওয়াল করবে।

সবশেষে, এ সংঘর্ষের সবচেয়ে ভয়াবহ সম্ভাবনাটি হচ্ছে পারমাণবিক যুদ্ধের শঙ্কা। ইরান এখনও পারমাণবিক অস্ত্রধারী নয় বলে দাবি করলেও, ইসরায়েল বরাবরই বলে এসেছে তারা ইরানকে পরমাণু শক্তিধর হতে দেবে না। যদি যুদ্ধের মাত্রা আরও বাড়ে, তাহলে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যার পরিণতি হবে আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য চরম হুমকি।

১৩টি যুদ্ধবিমান হারানোর ঘটনা নিছক একটি সামরিক ব্যর্থতা নয়—এটি একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং কৌশলগতভাবে জটিল সংঘর্ষের এক সূচনা হতে পারে। এই পরিস্থিতি কীভাবে বিকশিত হবে, তা নির্ভর করছে পরবর্তী পদক্ষেপগুলোর ওপর—যা কেবল যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, বরং বিশ্ব কূটনীতি, প্রযুক্তি এবং শক্তি রাজনীতির প্রতিটি স্তরে প্রতিফলিত হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

এ জাতীয় আরো খবর..

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২৫