প্রকাশ: ১৩ জুন, ২০২৫ • আজকের খবর অনলাইন
ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গোড্ডায় অবস্থিত আদানি গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমদানিকৃত কয়লার মূল্য নিয়ে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও আদানি কর্তৃপক্ষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলমান বিরোধ নিষ্পত্তির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। প্রায় দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা এ বিতর্কের অবসান ঘটাতে চলতি মাসের ২৩ জুন গুরুত্বপূর্ণ এক বৈঠকে বসতে চলেছে দুই পক্ষ। সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, এই বৈঠকের মাধ্যমে কয়লার মূল্য নির্ধারণ সংক্রান্ত জটিলতা ও পরবর্তী বিদ্যুৎ সরবরাহের আর্থিক কাঠামো নিয়ে সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হবে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে আদানির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি একটি চুক্তি করে পিডিবি। চুক্তির আওতায়, ২৫ বছরব্যাপী আদানির ১,৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানির কথা বলা হয়। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দুটি ইউনিটে বিভক্ত, প্রতিটির উৎপাদন ক্ষমতা ৮০০ মেগাওয়াট। গত বছরের এপ্রিল মাসে প্রথম ইউনিট ও জুনে দ্বিতীয় ইউনিট চালু হওয়ার পর থেকে কেন্দ্রটি বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছে।
কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের আগেই শুরু হয় মূল সংকট— কয়লার মূল্য নির্ধারণ নিয়ে মতবিরোধ। আদানির পক্ষ থেকে যে দাম প্রস্তাব করা হয়, সেটিকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে উল্লেখ করে পিডিবি তা প্রত্যাখ্যান করে। পরবর্তীতে আদানি সাময়িকভাবে কম মূল্যে কয়লা সরবরাহে সম্মত হলেও, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে তারা আবারও পুরোনো দামের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি বিল পাঠাতে শুরু করে। এতে দু’পক্ষের মধ্যে আর্থিক হিসাবে বড় ধরনের ফারাক দেখা দেয়।
পিডিবির হিসাব অনুযায়ী মে মাস পর্যন্ত আদানির কাছে বকেয়া বিলের পরিমাণ ৪৮ কোটি ডলার, অথচ আদানির দাবি অনুযায়ী এই পরিমাণ ৭০ কোটি ডলার। এ বিষয়ে পিডিবি অভিযোগ করে যে, চুক্তিতে থাকা মূল্য নির্ধারণ সূত্রকে আদানি নিজের মতো ব্যাখ্যা করে বাড়তি বিল করছে। এ নিয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে একটি ভার্চুয়াল বৈঠকে পিডিবি পক্ষ থেকে আদানিকে বিদ্যমান মূল্যছাড় অব্যাহত রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে সাড়া না দিলেও, পরবর্তীতে লিখিত প্রস্তাব পাওয়ার পর আদানি পক্ষ আলোচনায় বসতে রাজি হয়। সেই আলোচনার ধারাবাহিকতায়ই জুন মাসের এই বৈঠক হতে যাচ্ছে, যেখানে আইনি পরামর্শকরাও উপস্থিত থাকতে পারেন।
পিডিবি চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বলেন, “চুক্তিতে কয়লার দামের সূত্র স্পষ্টভাবে নির্ধারিত রয়েছে। বিষয়টি আইনগত হলেও, আমরা আলোচনার মাধ্যমেই একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে চাই।” তিনি আরও জানান, কেবল কয়লার মূল্য নয়, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের অন্যান্য বিষয়ও আলোচনায় আসবে।
বিশ্ববাজারে কয়লার মূল্য নির্ধারণে সাধারণত অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসল ও ইন্দোনেশিয়ার মূল্য সূচক বিবেচনা করা হয়। আদানির সঙ্গে চুক্তিতে এই দুটি সূচকের গড় মূল্যকেই ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে। তবে অভিযোগ রয়েছে যে, বিশেষ ছাড়ে কয়লা কিনলেও আদানি সেই ছাড় পিডিবিকে দিচ্ছে না।
চুক্তিটি নিয়ে সরকারি একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি কাজ করছে। কমিটির এক সদস্য জানিয়েছেন, এই চুক্তিটি পূর্ববর্তী সরকারের আমলে স্বাক্ষরিত এবং এতে বিদ্যুৎ সরবরাহের পাশাপাশি কয়লা বিক্রির ক্ষেত্রেও আদানির লাভবান হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে, যা বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক স্বার্থের পরিপন্থী হতে পারে।
এদিকে, আদানি বিদ্যুৎ কোম্পানির প্রধান নির্বাহী শেরসিং বি খিয়ালিয়া সম্প্রতি ঢাকায় এসে পিডিবির চেয়ারম্যান এবং বিদ্যুৎ সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। যদিও ২৩ জুনের বৈঠকটি ভার্চুয়ালি হবে নাকি সরাসরি, তা এখনো নির্ধারিত হয়নি।
যদিও এখন পর্যন্ত আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে, তবে কয়লার মূল্যবিষয়ক এই বিরোধ ভবিষ্যতে প্রকল্পটির অর্থনৈতিক ভারসাম্যে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। তাই আসন্ন বৈঠকটি শুধু বর্তমান সংকটের সমাধান নয়, বরং দুই দেশের জ্বালানি সম্পর্কের ভবিষ্যতের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।