আজকের খবর অনলাইন
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৫
নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট
সিলেট শহরে কয়েক ঘণ্টার টানা ভারী বর্ষণে নগরীর প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। শুক্রবার গভীর রাত থেকে শুরু হয়ে শনিবার সকাল পর্যন্ত বিরতিহীন বর্ষণের ফলে জিন্দাবাজার, শাহজালাল উপশহর, খাসদবীর, দরগাহ মহল্লা, দক্ষিণ সুরমা, শিবগঞ্জ, যতরপুর, মেজরটিলা—এসব এলাকাসহ অসংখ্য সড়ক ও মহল্লা পানির নিচে তলিয়ে যায়। সড়কে জলাবদ্ধতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে শহরের স্বাভাবিক জনজীবন একপ্রকার থমকে দাঁড়িয়েছে।
শনিবার সকালে নগরবাসীকে চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে গন্তব্যে যেতে হয়েছে। স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী, অফিসগামী কর্মজীবী মানুষ এবং জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া সাধারণ নাগরিকদের একদিকে যানবাহন সংকটে পড়তে হয়েছে, অন্যদিকে জলাবদ্ধতার কারণে ঘর থেকে বের হয়েই হাঁটু বা কোমর সমান পানিতে আটকে পড়েছেন তারা। অনেকেই বাধ্য হয়ে ভিজে, হাঁটু পানিতে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। গণপরিবহন বন্ধ না হলেও অনেক রুটে বাস বা রিকশা চলাচল কার্যত বন্ধ হয়ে পড়ে।
শাহজালাল উপশহরের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম শ্যামল বলেন, “গত বাইশ সালের বন্যার মতই অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। আমার বাসার নিচতলা পর্যন্ত পানি ঢুকে গেছে। আশেপাশের বাসিন্দারা যার যার মতো করে নিরাপদ জায়গায় সরে যাচ্ছেন।”
একইরকম অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন দরগাহ মহল্লার বাসিন্দা ও সাংবাদিক মো. আজমল আলী। তিনি বলেন, “অলিগলি ভরে গেছে পানিতে। আমার বাসাতেও পানি উঠেছে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হচ্ছে, এভাবে যদি বৃষ্টি চলতেই থাকে, তাহলে ঘরের আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে যাবে। প্রশাসনের তরফ থেকে এখনো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা চোখে পড়েনি।”
এমন দুর্যোগপূর্ণ অবস্থার পেছনে রয়েছে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট একটি নিম্নচাপ, যার প্রভাবে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর আগেই সতর্ক করেছিল, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুরু হয়ে আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের সাতটি বিভাগে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে, যার পরিমাণ ৪৪ মিলিমিটার থেকে ১৮৮ মিলিমিটার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। যদিও চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া অন্য কোথাও ভূমিধ্বসের আশঙ্কা নেই বলে জানানো হয়েছে, তবে সিলেটের মতো নগরীতে জলাবদ্ধতা জনজীবনে বিরাট প্রভাব ফেলছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্যমতে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি সাতক্ষীরা ও তৎসংলগ্ন এলাকা অতিক্রম করে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে এখন শেরপুর ও ভারতের মেঘালয় অঞ্চলে অবস্থান করছে। যদিও নিম্নচাপটি ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়েছে, তবুও এর প্রভাবে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভারী বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে।
আবহাওয়ার এই পূর্বাভাস সত্ত্বেও নগর কর্তৃপক্ষ কিংবা সিটি কর্পোরেশন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়নি বলেই অভিযোগ উঠেছে। সিলেটের নাগরিক সমাজ বলছে, জলাবদ্ধতা প্রতিরোধে দীর্ঘদিন ধরে কার্যকর ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বাস্তবে এর খুব কমই বাস্তবায়ন হয়েছে। ফলে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে সিলেটের নাগরিকদের এই দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, খাল-নালার দখল এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থার অকার্যকারিতা—এসবই জলাবদ্ধতার মূল কারণ। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে পানিনিষ্কাশনের জন্য যে অল্প কিছু পাম্প রয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল এবং বৃষ্টির সময় প্রায়ই বন্ধ হয়ে থাকে বা ঠিকভাবে কাজ করে না।
অন্যদিকে, সিলেট বিভাগজুড়েই বৃষ্টিপাতের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত এক সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিনই গড় বৃষ্টির পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ ছিল। কৃষিজমি ও মাছের ঘের এরইমধ্যে পানিতে তলিয়ে গেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় প্রশাসন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে আরও সক্রিয় হওয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছেন নগরবাসী। সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ পাওয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন কতটা কার্যকরভাবে হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
সিলেটের এই অব্যাহত জলাবদ্ধতা কেবল একটি আবহাওয়া-নির্ভর দুর্যোগ নয়, বরং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি অব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বহীনতার প্রতিফলন। প্রশাসনের দ্রুত ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ না এলে এই সংকট আরও ঘনীভূত হবে এবং জনজীবনকে প্রতিনিয়ত দুর্বিষহ করে তুলবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বৃষ্টিপাত কিছুটা কমার সম্ভাবনার কথা জানালেও ততদিনে সিলেটের অনেক নিচু এলাকা ডুবে থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকারি ত্রাণ সহায়তা এবং জরুরি সেবার প্রস্তুতি থাকাও অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। এখন দেখার বিষয়—নগর প্রশাসন ও কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ এই সংকটে কতটা মানবিক ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হ