প্রকাশ: আজকের খবর অনলাইন | ৩০ মে ২০২৫ | নিজস্ব সংবাদদাতা
বাংলাদেশের সরকারি সেবা ব্যবস্থার এক দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে ঘুষ। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা যখন সাধারণ নাগরিকের ন্যায্য অধিকার আদায়ে বাধা হয়ে দাঁড়ান, ঘুষ না দিলে ফাইল আটকে রাখেন বা কাজ না করার জন্য অপারগতা প্রকাশ করেন, তখন সেটি শুধু একটি ব্যক্তির দুর্নীতি নয়—বরং এটি পুরো মানবতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের শামিল। যারা ঘুষ খায়, তারা রাষ্ট্র ও সমাজের নিকৃষ্ট শত্রু। এরা প্রশাসনিক শৃঙ্খলা, নৈতিকতা এবং জনস্বার্থের পীঠস্থানকে কলুষিত করে। তাই ঘুষখোর কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবার-পরিজনকে রাষ্ট্রের সামনে উন্মোচন করা কেবল একটি সামাজিক দায় নয়, বরং এটি একটি নাগরিক দায়িত্ব।
এই ভয়াবহ দুর্নীতির আরেক প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি কুয়াকাটার সদ্য নির্মিত সৈকতসংলগ্ন সড়ক ধ্বংসের ঘটনায়। ২৯ মে সন্ধ্যার পর অস্বাভাবিক জোয়ার ও মুষলধারে বৃষ্টির প্রভাবে কলাপাড়া উপজেলার সাগরঘেঁষা ওই রাস্তার বিশাল অংশ ধসে পড়ে। এলাকাটি একেবারে শূন্য পয়েন্টসহ আশপাশের জনপদে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বেড়িবাঁধের বাইরের শত শত মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কৃষিজমি, মাছের ঘেরসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো পানির নিচে চলে গেছে।
এই দুর্ঘটনার পর, কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রবিউল ইসলাম তাৎক্ষণিকভাবে একটি পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে কুয়াকাটা পৌরসভার প্রশাসক ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ ইয়াসীন সাদেককে। সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর, এলজিইডি এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের। তাদের আগামী সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তদন্তের প্রাথমিক তথ্যে উঠে এসেছে আরও উদ্বেগজনক তথ্য। সড়কটির নির্মাণকাজ ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। সস্তা লোকাল বালি, পাতলা সিসি ঢালাই আর প্রয়োজনীয় টেকনিক্যাল যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই নির্মাণ কার্যক্রমে যাওয়া হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন থেকে বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও তৎকালীন পৌর কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি।
জানা গেছে, কুয়াকাটা সৈকতের পূর্ব প্রান্তে ট্যুরিজম পার্ক এলাকা থেকে শুরু করে প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাবেক মেয়র এবং আওয়ামী লীগ নেতা মো. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার। প্রকল্পটি তিনটি প্যাকেজে ভাগ করা হলেও কেবল ১৩০০ মিটার অংশের নির্মাণ কাজই কোনোভাবে সম্পন্ন করা হয়। বাকি ৭০০ মিটার কাজের কোনো অগ্রগতি হয়নি। কিন্তু মাত্র একদিনের প্রাকৃতিক তাণ্ডবেই প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ রাস্তা বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে।
ঘটনার পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। স্থানীয় পর্যটন ও পরিবেশ কর্মী কেএম বাচ্চু নিজের ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ব্যর্থ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করতেই হবে। অনেকে অভিযোগ করেন, সাবেক মেয়র আনোয়ার হাওলাদার এই প্রকল্পকে তার ব্যক্তিগত উদ্যোগ হিসেবে ব্যবহার করেছেন এবং নিয়মিত টেন্ডার ছাড়াই আত্মীয়-স্বজন দিয়ে কাজ শুরু করেছেন।
এইসব অভিযোগের সঠিক তদন্ত না হলে বারবার এভাবেই রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় হবে, আর সাধারণ মানুষ উন্নয়ন নামক প্রতারণার শিকার হবে। সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বহীনতা ও দুর্নীতি দেশের অগ্রযাত্রায় এক বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনসাধারণের প্রতি আমাদের আহ্বান, আপনারা যদি কোনো ধরনের ঘুষ প্রদানে বাধ্য হয়ে থাকেন বা এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রমাণ আপনার হাতে থাকে, তবে তা আমাদের কাছে পাঠান। আপনার পরিচয় গোপন রেখে আমরা সেই দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করবো এবং আইনানুগ সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত থাকবো।
এই দেশ আমাদের সবার। দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়ের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে দুর্নীতিবাজদের মুখোশ উন্মোচন করা আজ আমাদের জরুরি মানবিক দায়িত্ব।