৩০ মে ২০২৫, আজকের খবর অনলাইন, নিজস্ব সংবাদদাতা – ১৯৭০ সালের এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর সাতক্ষীরার হাঁড়িভাঙ্গা নদীর মোহনায় বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় এক নতুন ভূখণ্ডের আবির্ভাব ঘটে। ধীরে ধীরে ‘দক্ষিণ তালপট্টি’ নামক একটি দ্বীপ জেগে ওঠে, যার আয়তন ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং এক সময় প্রায় ১০ হাজার বর্গমিটার পর্যন্ত পৌঁছে। তবে এই বিশাল দ্বীপটির উপর বিরাট আকর্ষণ তৈরি হয় প্রতিবেশী দেশের মাঝে, যা পরবর্তীতে অঞ্চলটির রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উত্তেজনার সূত্রপাত ঘটে।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী ‘হারত’ নামক দ্বীপটির মালিকানা দাবি করতে শুরু করে। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়া উর রহমান উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল হারত দ্বীপে পাঠান ১৯৭৯ সালে, কিন্তু দুই দেশের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার যাত্রা ব্যর্থ হয়। এমনকি ব্যক্তিগত উদ্যোগে জিয়া নিজেও দ্বীপটির মালিকানা সংক্রান্ত আলোচনা করতে যান, যেখানে কোন ফল মেলেনি। পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হতে থাকে।
১৯৮০ সালের ২০ ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নরসীমা রাও একটি বিতর্কিত ঘোষণায় দাবি করেন, হারত দ্বীপ ভারতের মালিকানা। জেনারেল জিয়ার সরকার এই দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদে স্পষ্টভাবে জানায়, দ্বীপটি বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে এবং ১৯৮১ সালের ১১ মে ভারতীয় “আইএসএন সন্ধায়ক” নামক যুদ্ধজাহাজ হারত দ্বীপ দখল করে নেয়।
অবস্থান সংকট গুরুতর আকার ধারণ করলে, মাত্র দুই দিন পর ১৩ মে রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান কমান্ডে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ‘বিএনএস উমর ফারুক’ জাহাজ নিয়ে ভারতীয় শক্তি দমন করে দ্বীপটি পুনরুদ্ধার করে। এই অভিযান বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হলেও পরবর্তীতে এই সময়ের ঘটনাগুলো দেশের ইতিহাসে রহস্য আর কষ্টের অধ্যায় হয়ে দাঁড়ায়।
দু’টি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব—রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া উর রহমান এবং রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান—দেশের সেবায় নিয়োজিত থাকাকালীন সময়ে রহস্যজনকভাবে জীবন হারান। জিয়ার মৃত্যু হয় ১৯৮১ সালের জুন মাসে, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক দুঃখজনক ও নাটকীয় ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। এরপর তিন বছর পর মাহবুব আলী খানের মৃত্যুর রহস্যেও ব্যাপক গুঞ্জন শুরু হয়। একাধিকবার তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও কখনও তাদের কোন নির্দিষ্ট প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি এবং এই মৃত্যু রহস্য আজও অমীমাংসিত থেকে গেছে।
অবশেষে ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক আদালত দক্ষিণ তালপট্টি তথা হারত দ্বীপের পুরো মালিকানা বাংলাদেশকে দিয়েছে। এই বিজয় ছিলো দীর্ঘ দিনের লড়াই ও সংগ্রামের প্রতিফলন। তবে এরপরও দেশের অনেকেই মনে করেন এই ঐতিহাসিক বিজয়ের যথাযথ স্বীকৃতি বা যথার্থ প্রভাব পড়ে নাই। সেদিন বাংলাদেশের জনগণ আনন্দ উৎসবে মেতেছিল, ঢোল-তবলা বাজিয়ে উদযাপন করেছিল সমুদ্রসীমার এই মহাবিজয়কে, কিন্তু দেশের গভীরে রয়েছে গভীর একটি বেদনা ও অসম্পূর্ণতা।
হারত দ্বীপের মালিকানা নিয়ে দীর্ঘ সময়ের উত্তেজনা, ঐতিহাসিক নায়ক জিয়া ও মাহবুব আলীর অকাল মৃত্যু, সেই সঙ্গে দ্বীপকে কেন্দ্র করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ওঠাপড়া, সব মিলিয়ে বাংলাদেশের এক মর্মান্তিক গল্প। এটি শুধু ভূখণ্ডের প্রশ্ন নয়, দেশের জাতীয়তা, মর্যাদা এবং ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক আত্মিক যন্ত্রণার গল্প।
আজও হারত দ্বীপের নাম যখন উচ্চারিত হয়, তখন সেই সময়কার পরিস্থিতি, দুই মহান নেতার ত্যাগ এবং দেশের স্বার্থের জন্য তাঁদের অবদান স্মরণ করিয়ে দেয়। হারতের প্রেম মানে বাংলাদেশের জাতিগত ও ঐতিহাসিক পরিচয়ের সঙ্গে একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। আর সেই সম্পর্কের জন্যই আজও দেশের মানুষ অনেক কিছু স্বীকার করতে রাজি হয় না।
যখন আমরা হারতের ইতিহাস স্মরণ করি, তখন শুধু একটি দ্বীপ নয়, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের এক চিরন্তন উদাহরণ আমাদের সামনে উঠে আসে। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—একটি দেশের সুরক্ষা ও সম্মানের জন্য কতটুকু ত্যাগ করা যায় এবং সেই ত্যাগের মূল্য কতটাই না গভীর।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এই অধ্যায় যেন প্রজ্বলিত থাকে এক অম্লান দীপের মত, যা দেশের নতুন প্রজন্মকে দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা ও প্রেমের শিক্ষা দেয়।