প্রকাশ: আজকের খবর অনলাইন | ৩০ মে ২০২৫ | নিজস্ব প্রতিবেদক
দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ও ভারত জুড়ে যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বহু ষড়যন্ত্র, হত্যাকাণ্ড ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির দুঃসহ ইতিহাস—সে ব্যক্তি এখন সেনাবাহিনীর হেফাজতে। তার নাম সুব্রত বাইন। এক সময় যাকে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে মাথার দাম ঘোষণা করেছিল, ইন্টারপোল যে অপরাধীকে রেড কর্নার নোটিশে তালিকাভুক্ত করেছিল, আজ সেই ব্যক্তি ঢাকার মাটিতে আছেন — তবে সাধারণ জনতার ভেতরে নয়, বরং সেনাবাহিনীর একটি অজ্ঞাত হেফাজতে।
সুব্রত বাইন, যিনি একাধিক পরিচয়ে পরিচিত—তিমোথি, আলী মোহাম্মদ, এবং কখনো কখনো তানভীর জয় বা ‘স্নাইপার ঘোস্ট’ নামে—তার অপরাধের খতিয়ান কেবল বিস্তৃতই নয়, ভয়ংকরভাবে রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকভাবে সংযুক্ত। তার বিরুদ্ধে থাকা মামলার সংখ্যা শতাধিক। এর মধ্যে রয়েছে হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজি, এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থা বা নেতাদের বিরুদ্ধে সরাসরি হামলার অভিযোগ। তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অন্তত ৩০টির মতো হত্যাকাণ্ডের মামলায় সে সাজাপ্রাপ্ত এবং অনেক মামলায় সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ছত্রছায়ায় থেকে রক্ষা পেয়েছে।
২০০১ সালে বিএনপি সরকারের সময় তাকে ‘শীর্ষ ২৩ সন্ত্রাসী’র মধ্যে প্রথম নম্বরে রাখা হয়েছিল। তার নামে পুরস্কার ঘোষণা করা হয় ১ লক্ষ টাকা। কিন্তু এই পুরস্কারের মুখ চেয়ে থাকেনি সুব্রত। বরং, তার নিজের গোপন পথ তৈরি হয়—ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করে সে পৌঁছে যায় কলকাতায়, যেখানে তাকে আশ্রয় দেয় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’।
ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পরপরই তাকে নিয়ে কাজ শুরু করে ‘র’ এবং সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা এমআই। তার প্রশিক্ষণ হয় মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশের সেনা ঘাঁটিতে, যেখানে তাকে কমান্ডো প্রশিক্ষণের পাশাপাশি দেওয়া হয় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন স্নাইপার রাইফেল, দূরপাল্লার লক্ষ্যভেদ, সাইবার কমিউনিকেশন এবং কোডেড টার্গেট সিগন্যালিং-এর মতো বিষয়গুলো শেখানো হয়। তার সঙ্গে জড়িত করা হয় আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদ ও তানভীর জয়কে। এই ত্রয়ী পরে হয়ে ওঠে ভারতের ছায়াযুদ্ধের প্রক্সি সৈনিক, যারা বাংলাদেশে রয়ে যাওয়া চীনা প্রভাব, পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিক এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে নিয়োজিত হয়।
তাদের মাধ্যমেই সন্ত্রাসের ছদ্মবেশে হত্যা করা হয় মোহাম্মদপুরে বসবাসরত নাগা সম্প্রদায়ের নেতা ও তার পরিবারকে। মোস্তাকিম চাপ কাবাবের মালিক মোস্তাকিমকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। সবই করা হয় গোয়েন্দা নির্দেশে এবং ভারতের জন্য অপারেশনাল সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যেই।
সুব্রতের আন্তর্জাতিক যাত্রাও একইভাবে বিস্ময়কর। সিঙ্গাপুর, চীন, পরে দুবাই হয়ে সে পৌঁছায় টাইগার মেমনের নেটওয়ার্কে, যেখান থেকে চেষ্টা ছিল মাফিয়া গডফাদার দাউদ ইব্রাহিমের চক্রে প্রবেশের। এসব অভিজ্ঞতা তার অপরাধের পরিধি যেমন বাড়িয়েছে, তেমনি তাকে করে তুলেছে এক পেশাদার গুপ্তঘাতক।
কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে তার পুনরায় প্রবেশ ঘটে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তখন কলকাতা প্রেসিডেন্সি জেল থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় তাকে হস্তান্তর করে বাংলাদেশের সিলেট সীমান্ত দিয়ে র্যাবের কাছে পাঠানো হয়। ঢাকায় এনে তাকে রাখা হয় র্যাব সদর দপ্তরে। সেখানে তার সঙ্গে দেখা করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক র্যাব কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান এবং মনিরুল ইসলাম। সুব্রতকে তখন জানানো হয়—তাকে বিশেষ মিশনের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাজ্যে বসবাসরত একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতার টার্গেটেড এসাসিনেশন। তাকে দেওয়া হয় স্নাইপার ট্রেনিং, প্রশিক্ষণ চলে সপ্তাহের পর সপ্তাহ। নিশ্চিত করা হয়, সফল হলে তাকে ও তার পরিবারকে ভারতীয় পাসপোর্টে কানাডায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
এই মিশনের প্রস্তুতি যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন ৫ আগস্ট ২০২৪ বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে ঘটে বড় রকমের বিপর্যয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা হারায় শেখ হাসিনার সরকার। সেই সঙ্গে ভেঙে পড়ে সুব্রত বাইনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ছায়া অপারেশন ইউনিট। তাকে গোপনে বুঝিয়ে দেওয়া হয় তার মেয়ে বিথির কাছে।
এরপর শুরু হয় সুব্রতের অদৃশ্য চলাফেরা। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছদ্মবেশে অবস্থান করতে শুরু করে সে। আবারও পুরনো যোগাযোগ পুনরায় সক্রিয় করে। মতিঝিলের ইখতিয়ার, মোল্লা মাসুদ, সুইডেন আসলাম, লেদার লিটন, এমনকি ক্যাসিনো খ্যাত খালেদ ও সম্রাট—সবাইকে নিয়ে গড়ে তোলে একটি নতুন অপরাধ চক্র। অস্ত্র সংগ্রহ, চাঁদাবাজি, ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানে দখলদারি এবং ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার তার মূল এজেন্ডা হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি নেপালে পলাতক বিডিআর হত্যাকাণ্ডের অভিযুক্ত লেদার লিটনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে অস্ত্র সংগ্রহ এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করে হাইভ্যালু টার্গেট এসাসিনেশনের।
তবে এবার পরিস্থিতি বদলে যায়। দেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা এমআই এর একটি বিশেষ ইউনিট কয়েক মাসের নজরদারি ও ইলেকট্রনিক ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে নিশ্চিত হয় যে সুব্রত ঢাকাতেই অবস্থান করছে এবং ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এরপর একটি গোপন অভিযানে সেনাবাহিনীর বিশেষ দল রাজধানীর একটি আবাসিক এলাকা থেকে তাকে আটক করে।
বর্তমানে সুব্রত বাইন সেনা হেফাজতে থাকলেও বিষয়টি সরকারিভাবে এখনো ঘোষণা করা হয়নি। সেনাবাহিনীর একটি নির্দিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার হেফাজতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে একাধিক আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ সংযোগের বিষয় যাচাই করা হচ্ছে।
সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, সুব্রত বাইন এখন কেবল একটি নাম নয়; সে একেকটি নিরাপত্তা হুমকির ‘হাব’। তার অতীত, তার যোগাযোগ, এবং তাকে ঘিরে রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক ও অপরাধী নেটওয়ার্কের যে বিস্তার—তা শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলার জন্যই নয়, বরং রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের জন্যও এক ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সুব্রত বাইনের মতো ব্যক্তিদের বিষয়টি আর কেবল অপরাধ বিচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। এটি পরিণত হয়েছে একটি জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে। তার অতীত এবং বর্তমান জানার মাধ্যমে আমরা যেমন রাষ্ট্রের নিরাপত্তাব্যবস্থার ফাঁকফোকর দেখতে পাই, তেমনি ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির দিকনির্দেশনাও পেতে পারি।