প্রকাশ: আজকের খবর অনলাইন, ৩০ মে ২০২৫ | নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশের মোবাইল ব্যাংকিং খাতের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’ এখন এক চরম অভ্যন্তরীণ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা, গোপন সিন্ডিকেটের প্রভাব এবং বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে জর্জরিত। অনুসন্ধান থেকে পাওয়া তথ্য এবং সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নগদ এখন কার্যত সরকারি নিয়ন্ত্রণহীন একটি ছায়া-প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির সাবেক সিইও তানভীর এ মিশুক দীর্ঘদিন ধরে দেশীয় মোবাইল ফিন্যান্স খাতে প্রভাব বিস্তার করে আসছিলেন। যদিও গত বছর তিনি হঠাৎ বিদেশে চলে যান, তথাপি এখনও ইমেইল ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ বহাল রয়েছে। চলতি বছরের ১২ মে এক ইমেইলের মাধ্যমে মো. সাফায়েত আলমকে সিইও হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যিনি নিজেও বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন। অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, এই পদক্ষেপ ছিল একটি কৌশলগত চাল; মূল উদ্দেশ্য, বহিঃপ্রকাশে নেতৃত্বে পরিবর্তনের আভাস দেওয়া হলেও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ যাতে আগের মতোই তানভীরের হাতে থাকে।
নগদের ভেতর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের ডেটাবেইজ থেকে পরিকল্পিতভাবে মুছে ফেলা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক ও প্রশাসনিক নথি। আইটি বিভাগকে ব্যবহার করে এই কাজ চলছে অত্যন্ত গোপনে। তৈরি করা হচ্ছে মিথ্যা বিল, পেছনের তারিখে তৈরি ভাউচার, এবং অনুমোদনহীন ইভেন্ট ব্যয়ের প্রমাণ। এতে গত দুই মাসে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা গোপনে উত্তোলন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
১৮ মে রাতে ডেপুটি সিইও মুয়ীজ নাসনিম ত্বকীকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে তার বাসা থেকে। তার সঙ্গে জব্দ করা হয় কম্পিউটার, মোবাইলসহ বেশ কিছু ডিভাইস। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ছেড়ে দেওয়া হন। অভ্যন্তরীণ সূত্রের মতে, ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রভাবশালী নেতার ঘনিষ্ঠজনের হস্তক্ষেপেই এই মুক্তি ঘটে। মুক্তির পর থেকে ত্বকী আবারও আগের মত দাপটের সঙ্গে ভুয়া ভাউচার পাস করাতে শুরু করেন।
এদিকে, বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এসেছেন আরেকজন—আতিক মোর্শেদ। কোনো পদে না থেকেও তিনি নগদের অফিসের ছয় তলায় বসে কর্মকর্তা নিয়োগ, বরখাস্ত, এমনকি অভ্যন্তরীণ নীতিমালা তৈরিতে প্রভাব বিস্তার করছেন। তার স্ত্রী জাকিয়া সুলতানা নগদের কমপ্লায়েন্স বিভাগে নিয়োগ পেয়েছেন, এবং তার একাধিক আত্মীয় ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পদে স্থায়ীকরণ পেয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, আতিক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টার ছত্রছায়ায় এই প্রভাব বিস্তার করছেন।
নগদের পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্বিগ্ন হলেও তারা বলছে, আদালতের আদেশের বাইরে গিয়ে কোনো প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ তারা করতে পারছে না। ব্যাংকটির নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসাইন খান জানান, তারা পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং আদালতে আপিল করেছেন, শুনানির অপেক্ষায় আছেন।
এদিকে অডিট তদন্তে সহায়তাকারী অন্তত ১৯ জন কর্মকর্তা সম্প্রতি বহিষ্কৃত হয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর গোলাম মর্তুজা চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক সাইদুল খন্দকার, ইন্টারনাল কন্ট্রোল প্রধান খালেদ বিন কামালসহ আরও অনেকে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির প্রমাণ বাংলাদেশ ব্যাংক ও কেপিএমজি অডিট টিমের হাতে তুলে দিয়েছেন।
অন্যদিকে তানভীরের ঘনিষ্ঠ ফকির বিদার উদ্দিন আহমেদ, যিনি আগে তার এপিএস ছিলেন, তাকে হেড অব এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তার ভাষাগত ও প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়ে রয়েছে বিস্তর প্রশ্ন।
আরও উদ্বেগজনক তথ্য হলো, নগদের চিফ টেকনোলজি অফিসার আবু রায়হান, যিনি একটি হত্যা মামলার আসামি, তার চাকরির মেয়াদ আগস্টে শেষ হলেও সম্প্রতি তাকে ৯ মাসের এককালীন বেতন দেওয়া হয়েছে ওয়ান ব্যাংকের মাধ্যমে। অর্থাৎ তার হাতে পৌঁছে গেছে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা।
এই পুরো পরিস্থিতি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে নগদের গ্রহণযোগ্যতা ও আস্থাকে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। একটি মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের সিন্ডিকেট, দুর্নীতি ও অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণের উপস্থিতি শুধু প্রতিষ্ঠানটির জন্য নয়, দেশের আর্থিক ব্যবস্থার জন্যও ভয়াবহ সংকেত।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অবিলম্বে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত ও সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়া নগদের এই পরিস্থিতি থামানো সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে গ্রাহক আস্থা যেমন নষ্ট হবে, তেমনি বিনিয়োগকারীরাও মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন—যার প্রভাব পড়বে পুরো ডিজিটাল অর্থনীতির ওপর।