শিরোনাম :
শেখ হাসিনার বিচার শুরু হয়েছে, দলীয়ভাবেও আওয়ামী লীগের বিচার হওয়া উচিত: মির্জা ফখরুল উত্তরের অচেনা বিস্ফোরণ: লেবাননে ইসরাইলি ড্রোন হামলায় নিহত ৩, আহত ১৩ কারামুক্তির পর পর্দায় ফেরার বার্তা: ‘জ্বীন-৩’ দিয়ে ফিরলেন নুসরাত ফারিয়া জামায়াতের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ চীন সফরে জাতীয় সমাবেশে জামায়াতের বার্তা: ৭ দফা দাবিতে বড় গণসমাবেশের প্রস্তুতি বাস রুট পারমিট নিয়ে ঢাকার পরিবহন খাতে অস্থিরতা, সিদ্ধান্তহীনতায় আরটিসি বরিশালে টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা, অচল জনজীবন নিঃসঙ্গ জীবনের করুণ পরিণতি: পাকিস্তানে অভিনেত্রী হুমাইরা আসগরের পচনধরা লাশ উদ্ধার ব্যাটিং বিপর্যয়ে সিরিজ হাতছাড়া, হতাশ মিরাজ জানালেন ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা পুনরায় মহাসংঘর্ষ: রিয়াল-পিএসজির দ্বৈরথে আজ ইতিহাস লিখবে কে?

‘ফ্ল্যাগ ক্যারিয়ারের অভ্যন্তরে মাফিয়া নেটওয়ার্ক’—বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে ঘিরে নয়া ফাঁস ও পুরোনো দুর্নীতির ছক

আজকের খবর ডেস্ক
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন, ২০২৫
  • ৩৪ বার

প্রকাশ: ২৭শে জুন ২০২৫ | আজকের খবর ডেস্ক | আজকের খবর অনলাইন

ঢাকা থেকে কাতার, লন্ডন থেকে চট্টগ্রাম—বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাবাহী সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স‌কে নিয়ে বিতর্ক যেন থামতেই চায় না। ফেইসবুকে আল–জাজিরার জনপ্রিয় সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের সাম্প্রতিক এক পোস্টে এমন সব তথ্য ফাঁস হয়েছে, যা “মাফিয়া সংগঠন” অভিধাটা নতুন করে আলোচনায় এনেছে। সায়েরের টাইমলাইনে শেয়ার হওয়া গোপন নথি ও ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে—নারী সহকর্মীকে বিদেশি হোটেলের করিডর দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া পাইলটের সিসিটিভি, উড়োজাহাজের ভেতরে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগের স্বাক্ষ্য, এমনকি আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্রের সঙ্গে বিমানের কিছু কর্মীর প্রত্যক্ষ সখ্যতা। পোস্টটি ছড়িয়ে পড়ার পরে পাইলট কমিউনিটির একাংশ ইতিমধ্যে “ষড়যন্ত্র” বললেও, সায়ের জানিয়েছেন—বিষয়গুলোর প্রাথমিক যাচাই করে তবেই তিনি সর্বসমক্ষে এনেছেন।

অভিযোগ নতুন নয়। দ্য ডেইলি স্টার‌–এর এক বিশ্লেষণে বিমানকে সরাসরি “দুর্নীতির দুর্গন্ধময় জলাধার” বলে বর্ণনা করা হয়েছে; প্রতিষ্ঠানটির নীতি–নির্ধারণ থেকে টিকিট বিক্রি—সব স্তরেই অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে । ২০২৪ সালেই আবারও উত্তাপ ছড়ায় যখন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং-এর দায়িত্ব পায় বিমানের জোগ্যতা–নিরীক্ষা ছাড়াই। সম্পাদকীয় পর্যবেক্ষণে এই সিদ্ধান্তকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ আখ্যা দেয়া হয়েছিল ।

২০১৯ থেকে ২০২৪—এই ক’ বছরে অন্তত অর্ধডজন যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে বিমানের পাইলটদের বিরুদ্ধে। দায়িত্বকালে কেবিন ক্রুকে ককপিটে ডেকে লাঞ্ছনা করার নালিশের পাশাপাশি বিদেশি হোটেলে সহকর্মীকে জোর করে কক্ষে নিয়ে যাওয়ার ভিডিও ফুটেজও এখন অনলাইন ঘুরছে । অভিযোগের তদন্তে বেশিরভাগ সময়ই অভিযুক্ত কয়েক মাসের সাময়িক বরখাস্ত পান; এরপর খুঁটির জোরে পুনর্বহালের নজিরও আছে—যা ভুক্তভোগীদের according to rights-activists, “দ্বিতীয়বার শাস্তি”।

বিমানের নাম সবচেয়ে বেশি জড়িয়েছে স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের ঘটনায়। ২০২3-এর শেষ দিনেই দুবাই–চট্টগ্রাম রুটের একটি বিমানে সিটের নিচ থেকে উদ্ধার হয় ২.৩২ কেজি স্বর্ণবার; ছয় মাস আগেই ১২৪ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার হয়েছিল কেবিন প্যানেল থেকে—যেখানে যাত্রী তো বটেই, কেবিন ক্রুরাও ঢুকতে পারেন না, কেবল ইঞ্জিনিয়ার বা গ্রাউন্ড স্টাফের ‘অ্যাকসেস কার্ড’ কার্যকর। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্তত ৩০০ স্থায়ী ও বরখাস্ত কর্মী এই চক্রে সক্রিয়। কখনও মৃতদেহের কফিন, কখনও রান্নাঘরের ট্রলি—হরেক কৌশলে স্বর্ণ পাচারের অভিযোগ ধরা পড়েও থামছে না।

দুর্নীতির লাগাম টানতে ২০২৪-এর শেষ দিকে বিমানের পরিচালনা বোর্ড ‘গোপন হটলাইন’ চালু করে এবং ভুয়া অভিযোগে শাস্তির হুঁশিয়ারিও দেয়। একই সময়ে বিমান মন্ত্রণালয় জানায়, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ও পাইলট নিয়োগে জিরো টলারেন্স নীতি নেয়া হয়েছে; কয়েকজন প্রশিক্ষণরত পাইলটকে বিদেশ থেকে ফেরাতেও নির্দেশ দেয়া হয়। তা সত্ত্বেও দুর্নীতির মেরুদণ্ড ভাঙতে পারছে না কেন? দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০১৯ থেকে ২০২৪—এই পাঁচ বছরে বিমানের অন্তত ৬০ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে; তার মধ্যে ২২ জনের বিরুদ্ধে ১,১৬১ কোটি টাকার ক্ষতির অভিযোগ যুক্ত, যা বোয়িং–৭৭৭ লিজ কেলেঙ্কারির ফাইলে নথিভুক্ত। মামলাগুলোর অধিকাংশই বারবার মুলতবি কিংবা ‘তথ্যসংগ্রহ ধীরগতি’ অজুহাতে ঝুলে আছে।

বিমানের অভ্যন্তরে দুই দাপুটে গোষ্ঠীর কথা পুরোনো: ‘পাইলট বংশ’—যাঁদের বাবা-চাচা হয়তো স্বাধীনতাপর যাবতীয় বিমান অপারেশনের রূপকার, অন্যদিকে অবসরে যাওয়া বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাদের ‘সাবেক এয়ারফোর্স ক্লাব’। পর্দার আড়ালে একে অপরকে ‘অচ্ছুত’ বা ‘দখলদার’ বললেও বড়সড় চোরাচালান হলে দুই পক্ষই এক টেবিলে বসে—কথা বিশেষজ্ঞদের। ফলাফল: অদৃশ্য সুরক্ষা–বলয়ে বছর বছর পাল্টে যায় বোর্ড, কিন্তু জায়গা বদলায় না দুর্নীতির শিকড়।

বিমান কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র একাধিকবার দাবি করেছেন, “রাষ্ট্রের ফ্ল্যাগ ক্যারিয়ারকে কালিমালিপ্ত করতে একটি চক্র ষড়যন্ত্রে লিপ্ত” এবং “বিমান শুধু যাত্রীসেবা নিয়ে ব্যস্ত—চোরাচালান, হয়রানি বা অন্য কোনো অপরাধ বরদাশ্ত করা হবে না”। তবে এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবে কতটা কার্যকর, তা নিয়ে সংশয় বাড়ছে—কারণ বড় কোনও শাস্তির নজির এখনও চোখে পড়ে না, বরং মামলা–মোকদ্দমা তালগোল পাকিয়ে সময়ের স্রোতে মুছে যায়।

দেশি-বিদেশি উড্ডয়ন বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, “বিমানের বর্তমান কাঠামো নিজেই নিজেকে শোধরানোর মতো স্বচ্ছ নয়।” আন্তর্জাতিক অ্যাভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্কের (ASN) সাবেক পরামর্শক ক্যাপ্টেন রিচার্ড হফম্যান মন্তব্য করেন, “যেখানে একই পাত্রে ব্যবসা, নিয়ন্ত্রণ, তদন্ত—সব মিশে যায়, সেখানে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ অনিবার্য। বিমানের ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটছে।” তিনি আরও বলেন, ফ্ল্যাগ ক্যারিয়ারকে উন্মুক্ত শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত, স্বতন্ত্র পরিচালনা পরিষদ দিয়ে চালানো না গেলে রাষ্ট্রের অক্সিজেন খরচ বাড়তেই থাকবে।

বিশ্বের অন্যান্য জাতীয় এয়ারলাইনের উদাহরণ টেনে অর্থনীতিবিদ ড. সায়েমুল হক বলেন, “জাপানের জেএল, ইতালির ইতিহাদ, এমনকি ভারতের এয়ার ইন্ডিয়াও কাঠামোগত সংস্কারে বেসরকারি অংশীদারকে এনে বহুপাল্লার তদারকি ও প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু বিমানে রাজনৈতিক মোহ ভেঙে স্বচ্ছ তদারকি, সিবিআইপি-স্টাইল বাইরের নিরীক্ষা, এবং কঠোর পেশাগত নীতিচর্চা—এসব ছাড়া দুর্নীতির মেটাস্ট্যাসিস ঠেকানো অসম্ভব।”

চোরাচালান থেকে যৌন হয়রানি—বিমানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ, কিন্তু জবাবদিহি সামান্য। এবার এনোনিমাস-র ফাঁস, দুদকের মামলার মেয়াদোত্তীর্ণ পর্ব ও জনমাধ্যমের চাপ একসঙ্গে জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদরুদ্দীন উমর মনে করিয়ে দেন, “একটা সময় যে কোনও অপরাধেরই বৌদ্ধিক রক্ষণাবেক্ষণ দুর্বল হয়ে যায়—তখনই হয় বিস্ফোরণ।”

বিমানকে নিয়ে সেই ‘বিস্ফোরণ’ কি এবার? নাকি পুরোনো কায়দায় আবারও ‘সাময়িক বরখাস্ত, পরে প্রত্যাবর্তন’? উত্তর হয়তো শিগগিরই স্কাই ট্রাফিক রিপোর্টে দেখা দেবে—কিন্তু আজ নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ফ্ল্যাগ ক্যারিয়ারের ব্র্যান্ড আপাতত তারই পতাকায় জড়িয়ে থাকা দুর্নীতির কোঁচড়ে বন্দি।

নিউজটি শেয়ার করুন..

এ জাতীয় আরো খবর..

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২৫