প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫ | আজকের খবর ডেস্ক | আজকের খবর অনলাইন
বিশ্ব রাজনীতিতে আবারও উত্তাল হাওয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের অভ্যন্তরে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শনিবার রাতে তার নিজের প্রতিষ্ঠিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ প্রকাশিত এক পোস্টে তিনি এই দাবি করেন।
ট্রাম্পের ভাষ্য অনুযায়ী, ইরানের তিনটি পারমাণবিক কেন্দ্রে—ফোর্দো, নাতানজ এবং এসফাহানে—যুক্তরাষ্ট্র ‘অত্যন্ত সফল’ হামলা চালিয়েছে এবং হামলাকারী সব বিমান নিরাপদে ইরানের আকাশসীমা ত্যাগ করেছে। এই ঘোষণার পর মুহূর্তেই মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুন করে উত্তেজনায় ভরে ওঠে।
ট্রাম্পের পোস্টে বলা হয়:
“ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থল—ফোরদো, নাতানজ ও এসফাহানে—আমাদের অত্যন্ত সফল হামলা সম্পন্ন হয়েছে। সব বিমান এখন ইরানের আকাশসীমার বাইরে।”
বিশ্বজুড়ে এ ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। যদিও মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ কিংবা হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে এই হামলার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি দেয়া হয়নি, তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম এবং পর্যবেক্ষণ সংস্থা স্যাটেলাইট চিত্র ও স্থানীয় সূত্রে এর প্রাথমিক সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা চালাচ্ছে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তেহরানের সম্পর্ক টানটান উত্তেজনার মধ্যে রয়েছে। ২০১৫ সালের ঐতিহাসিক Joint Comprehensive Plan of Action (JCPOA) চুক্তি থেকে ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একতরফাভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। এর পর থেকেই ইরান আবার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদনের মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়াতে থাকে।
২০১৯ সাল থেকে একাধিক আন্তর্জাতিক পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থা অভিযোগ করে আসছে যে, ইরান আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন করে উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে, যা ভবিষ্যতে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণে ব্যবহারযোগ্য। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের ফোর্দো ও নাতানজ কেন্দ্রকে “স্ট্র্যাটেজিক থ্রেট” হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে।
ফোর্দো ইউরেনিয়াম এনরিচমেন্ট প্লান্ট পাহাড়ের নিচে একটি সুগভীর বাঙ্কারে অবস্থিত, যেখানে ইরান কৌশলগতভাবে সেন্সিটিভ মাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে থাকে। এই কেন্দ্রে ২০২৩ সাল থেকে ৬০% পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কাজ চালানো হচ্ছিল, যা পরমাণু বোমা তৈরির সীমানার এক ধাপ নিচে।
নাতানজ ইরানের সর্ববৃহৎ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, যেখানে শত শত সেন্ট্রিফিউজ একযোগে কাজ করে থাকে। পূর্বেও এই স্থাপনায় সাইবার হামলা এবং রহস্যজনক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, যার পেছনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার হাত থাকার সম্ভাবনার কথা বলা হয়।
এসফাহান পারমাণবিক স্থাপনাগুলো মূলত রূপান্তরিত ইউরেনিয়াম এবং সংশ্লিষ্ট কারিগরি ইনফ্রাস্ট্রাকচারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ভারী পানি রিঅ্যাক্টর এবং ফুয়েল প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট রয়েছে।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, হামলার পর ইরানের এসফাহান এবং নাতানজ এলাকায় উচ্চ শব্দের বিস্ফোরণ শোনা গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু অপ্রমাণিত ভিডিওতে দেখা যায়, আকাশে আগুনের শিখা এবং বিমানবাহিনীর অ্যাকটিভিটি।
তবে ইরানি রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ মাধ্যম এখন পর্যন্ত হামলার বিষয়টি সরাসরি স্বীকার করেনি। ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি আসেনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি এই হামলা সত্য হয়, তবে এটি মধ্যপ্রাচ্যে এক ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে। ইরান ইতোমধ্যে সিরিয়া, ইরাক, লেবানন ও ইয়েমেনে ঘনিষ্ঠ মিত্রদের মাধ্যমে প্রতিশোধমূলক হামলার প্রস্তুতি নিতে পারে।
ইসরায়েলও চলমান উত্তেজনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যদিও তারা বরাবরই ‘নো-কমেন্ট’ নীতিতে চলে।
মস্কো এবং বেইজিং ইতোমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, “যেকোনো একতরফা হামলা আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থী এবং স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে।”
চীন ‘সংযম’ প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়ে বলেছে, “আঞ্চলিক নিরাপত্তা আন্তর্জাতিক সমন্বয় ও সংলাপের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে, শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে নয়।”
ট্রাম্প তার পোস্টের শেষাংশে লিখেছেন, “এটা অত্যন্ত পরিণতি নির্ধারণকারী বিষয়। হয় পশ্চিমা একাধিপত্য শেষ হয়ে যাবে, নাহয় নতুন যুগের সূচনা হবে।”
তাঁর এই বক্তব্য ভবিষ্যতের বিশ্ব রাজনীতিতে একটি বিভক্ত পথের ইঙ্গিত দেয়। একদিকে পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন শৃঙ্খলাভিত্তিক বিশ্ব ব্যবস্থা, অন্যদিকে উদীয়মান প্রতিরোধ-ভিত্তিক সামরিক ও কূটনৈতিক বলয়—এই দুই ধারণার মুখোমুখি সংঘর্ষে হয়তো প্রবেশ করছে বিশ্ব।
তবে এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে কি—শক্তি, নাকি সংলাপ? প্রশ্ন থেকে যায়।
আন্তর্জাতিক কূটনীতিকরা এখন তাকিয়ে আছেন জাতিসংঘ, নিরাপত্তা পরিষদ এবং পরমাণু পর্যবেক্ষণ সংস্থা IAEA-এর প্রতিক্রিয়ার দিকে। কারণ পরবর্তী সিদ্ধান্ত, যুদ্ধ বা শান্তি—উভয়ই নির্ভর করবে কীভাবে এই ঘটনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় তার ওপর।
বিশ্ব আজ এক অনিশ্চিত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ট্রাম্পের ঘোষণা যদি সত্য হয়, তবে আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের অন্যতম স্পর্শকাতর অঞ্চলটি আর কখনো আগের মতো থাকবে না।