প্রকাশ: ১৮ই জুন ২০২৫ | আজকের খবর ডেস্ক | আজকের খবর অনলাইন
মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনার মাত্রা নতুন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে। সম্প্রতি ইরান-ইসরায়েল সংঘাত এবং মার্কিন হস্তক্ষেপমূলক নীতির জবাবে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং একটি কঠোর বার্তা দিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে আলোড়ন তুলেছেন। চীনের পক্ষ থেকে এটাই প্রথম উচ্চপর্যায়ের এমন এক ঘোষণাপত্র, যা স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
শি জিনপিং তাঁর বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্দেশ করে বলেন, সম্মান হারানোর আগে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। তিনি মনে করিয়ে দেন—যে কোনো সাম্রাজ্যের পতন অবধারিত, যদি তারা নিজেদের অপরিহার্য মনে করে এবং অতীতের শিক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ হয়। সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ প্রকাশিত তার বার্তায় তিনি অতীতের তিনটি প্রধান সাম্রাজ্যের পতনের উদাহরণ তুলে ধরেন—ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং স্পেন।
চীনা প্রেসিডেন্টের ভাষায়, ১০০ বছর আগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিশ্বের ২০ শতাংশ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ করত এবং অনেকেই মনে করত, এ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না। একইভাবে, ২০০ বছর আগে ফ্রান্স ইউরোপে একটি সংস্কৃতি-নির্ভর আধিপত্য বিস্তার করেছিল এবং সেনাবাহিনীর শক্তিতে তারা ছিল অপ্রতিরোধ্য। ৪০০ বছর আগে স্পেনের সাম্রাজ্য ছিল সমুদ্রপথে সর্ববৃহৎ, তাদের জাহাজগুলো রুপা ও রেশমে পূর্ণ থাকত।
শি মন্তব্য করেন, প্রতিটি সাম্রাজ্যই নিজেকে চিরস্থায়ী ভেবে ভুল করেছে। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে, ক্ষমতা ক্ষয় হয়, প্রভাব স্থানান্তরিত হয় এবং বৈধতা তখনই বিলুপ্ত হয়, যখন তা অর্জন নয়, বরং দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চায়। এমন ভাবনার ফসল হচ্ছে পতন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে পরামর্শ দেন—“যদি সম্মান হারাতে না চাও, তাহলে এখনই শিক্ষা গ্রহণ করো।”
একই সঙ্গে শি জিনপিং একটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির ব্যর্থতা। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র গত কয়েক দশকে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ও কৌশলগত হস্তক্ষেপে প্রায় ৮ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। এতে শুধু হাজার হাজার মার্কিন সেনা নিহত বা গুরুতরভাবে আহত হননি, বরং লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। শি’র মতে, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন হস্তক্ষেপ ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ভুল সিদ্ধান্তগুলোর একটি।
এই বার্তায় আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি কেবল কূটনৈতিক ভাষণ নয়, বরং চীন একটি নির্দিষ্ট ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান নিচ্ছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্যবাদী ভূমিকাকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। চীনের এ ধরনের অবস্থান পূর্বে দেখা যায়নি এত স্পষ্ট ও ধারালো শব্দচয়নে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানকে ঘিরে যদি যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে নতুন করে সংঘাতের সূচনা হয়, তবে চীন তা সহজভাবে নেবে না। বিশেষ করে, চীন মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে গভীর অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপন করছে এবং ইরান সেখানে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।
শি’র বার্তায় একাধিক অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকের ভাষ্যমতে, এ বক্তব্য যেন বিশ্ব রাজনীতিতে একটি নতুন যুগের সূচনা ঘোষণা। যেখানে পশ্চিমা শক্তিগুলোর প্রচলিত আধিপত্যবাদী অবস্থান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে চলেছে এবং বিশ্ব একটি ‘মাল্টি-পোলার’ বা বহু-মেরুবিশ্ব ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, বহু ধনী আরব রাষ্ট্র এখনও পশ্চিমাদের ছায়াতলে নিজেদের নিরাপদ মনে করে চলছে। কিন্তু চীনের এ ধরনের স্পষ্ট ভাষণ তাদেরও নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে—বিশ্ব কেবল একটি বলয়ের মাধ্যমে চলে না। আরব নেতাদের প্রতি সমালোচনামূলক ইঙ্গিত করে শি বলেন, “তারা মনে করছে তাদের আরাম-আয়েশ চিরস্থায়ী, কিন্তু ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে—সাময়িক নিরাপত্তা স্থায়ী সম্মান বা স্বাধীনতার বিকল্প নয়।”
বিশ্ব এখন চোখ রাখছে চীন-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনার পরবর্তী অধ্যায়ে—ইরানের ভূখণ্ডে বাস্তব যুদ্ধের চেয়ে কূটনৈতিক যুদ্ধেই হয়তো বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্র আরও বড় পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে চলেছে।