প্রকাশ: ১৮ই জুন ২০২৫ | মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ সিদ্দিক
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার চলমান সংঘাত আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে রূপ নিচ্ছে। তবে এ যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়েও উঠছে বড় প্রশ্ন। বিশেষ করে পশ্চিমা গণমাধ্যমের একচোখা কাভারেজ অনেকের চোখে ‘তথ্য-সন্ত্রাস’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিগত কয়েকদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, তেহরান আংশিক খালি হওয়া বা ইরানের প্রতিরক্ষা দুর্বলতা নিয়ে যখন বারবার সংবাদ প্রকাশ করছে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো, তখন একইসঙ্গে ইসরায়েলের তেল আবিব, হাইফা কিংবা রামাত ডেভিড বিমানঘাঁটি ধ্বংসের ঘটনাগুলো তারা এড়িয়ে যাচ্ছে। ইরান যেসব কৌশলগত হামলা চালিয়েছে, বিশেষ করে মোসাদ সদর দপ্তর, ইসরায়েলি জেনারেল স্টাফ হেডকোয়ার্টার, বায়োলজিক্যাল অস্ত্র কারখানা, কিংবা হাইফার তেল শোধনাগারে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় নীরবতা পালন করছে পশ্চিমা মিডিয়া।
বেশ কিছু সময় ধরে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো ইরানকে ‘পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে চাওয়া এক হুমকি রাষ্ট্র’ হিসেবে তুলে ধরছে। অথচ তারা কখনোই বলছে না—ইসরায়েল বহু আগেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে রেখেছে এবং কখনও আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থাকে (IAEA) তাদের পরমাণু স্থাপনায় প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। এর বিপরীতে, ইরান তার পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের জন্য উন্মুক্ত রেখেছে, এবং IAEA বহুবার তাতে প্রবেশ করেছে।
আরও বিস্ময়কর বিষয় হলো, ইরান যে পারমাণবিক অস্ত্র চুক্তিতে (NPT) স্বাক্ষর করেছে, তা পশ্চিমা গণমাধ্যম প্রায় উপেক্ষা করছে। অন্যদিকে, ইসরায়েল এখনো পর্যন্ত এই গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি—এমন তথ্যগুলো খুব কমই প্রচার করা হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইরানকে একচেটিয়াভাবে ‘আন্তর্জাতিক হুমকি’ হিসেবে উপস্থাপন করাটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারণ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—ইরান কোনও দেশের ভূখণ্ড দখল করেনি। অথচ ইসরায়েল ফিলিস্তিন, জেরুজালেমসহ নানা অঞ্চল দখল করে রেখেছে, যা জাতিসংঘ পর্যন্ত অবৈধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই দখলদারিত্বের শব্দগুলো ব্যবহার করতে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম চূড়ান্তভাবে অনিচ্ছুক।
ইরানে যদি সরকারবিরোধী বিক্ষোভ হয়, তা তখনকার টপ হেডলাইন হয়ে ওঠে। অথচ ইরান সরকারপন্থী বিক্ষোভ, বা ইসরায়েলে চলমান নেতানিয়াহু বিরোধী গণআন্দোলনের সংবাদ তারা গুরুত্ব সহকারে প্রচার করে না। একইভাবে, ফিলিস্তিনি জনগণের উপর যে ধারাবাহিক সহিংসতা ও দমন-নিপীড়ন চালানো হচ্ছে, তা এড়িয়ে যায় গণমাধ্যম।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, পশ্চিমা মিডিয়া আজ ফিলিস্তিনিদের হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিকদের ‘সন্ত্রাসী’ না বলে ‘পাহারাদার’ বা ‘প্রতিরক্ষাকারী’ হিসেবে তুলে ধরছে। যারা অবৈধভাবে বসতি স্থাপন করছে, তাদের দখলদার না বলে ‘সেটলার’ বলা হচ্ছে। এই ভাষা বদলের রাজনীতি আসলে একটি বৃহত্তর জেনোসাইড কাঠামোর অংশ—যেখানে তথ্য নিয়ন্ত্রণই সত্য নিয়ন্ত্রণের সমতুল্য।
বিশ্ব আজ দ্রুতগতির তথ্যপ্রবাহের যুগে প্রবেশ করলেও, তথ্যের নিরপেক্ষতা ও সত্যতা নিয়ে যখন প্রশ্ন ওঠে, তখন গণমাধ্যমের নৈতিক অবস্থান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। পশ্চিমা সভ্যতা, যারা নিজেদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মানদণ্ড রূপে তুলে ধরে, তাদেরই গণমাধ্যম যদি সত্য আড়াল করে, তবে সেই সভ্যতার মানবিকতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যায়।
সার্বিকভাবে, পশ্চিমা গণমাধ্যমের এমন পক্ষপাতমূলক এবং একমুখী কভারেজ বিশ্ব গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে হুমকির মুখে ফেলছে। তথ্যের মাধ্যমে সত্য বিকৃতি ও আংশিক বাস্তবতা উপস্থাপন বিশ্বের জনগণকে বিভ্রান্ত করছে—যা কেবল সাংবাদিকতার চরম অবনমনই নয়, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সত্য ও ন্যায়ের ধারণাকেও ধোঁয়াশায় ফেলে দিচ্ছে।
এখন সময় এসেছে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর—তথ্যকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে যুদ্ধকে ন্যায়সঙ্গত হিসেবে উপস্থাপন নয়, বরং ন্যায়ের পক্ষে তথ্য তুলে ধরাই হোক গণমাধ্যমের সত্যিকারের দায়িত্ব।