প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৫ | আজকের খবর অনলাইন | নিজস্ব সংবাদদাতা
ভারতের পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও কৌশলগত এলাকা হিসেবে পরিচিত শিলিগুড়ি করিডোর বা ‘চিকেনস নেক’ এখন অভূতপূর্ব সামরিক তৎপরতার মুখোমুখি। একদিকে শিলিগুড়ি করিডোরকে ঘিরে ভারতের প্রতিরক্ষা বলয় দ্রুত শক্তিশালী হচ্ছে, অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে দ্রুত পরিবর্তনশীল বাস্তবতা নয়াদিল্লিকে পূর্বমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিতে বাধ্য করেছে।
সম্প্রতি ভারত এই করিডোরে রাফাল যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাশিয়ার তৈরি অত্যাধুনিক এস-৪০০ (S-400) বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ২০ থেকে ২২ কিলোমিটার প্রশস্ত এই করিডোরটি ভারতের মূল ভূখণ্ডকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করে। করিডোরটি কেবল ভারতের জন্য নয়, বরং চীন, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের ভূ-কৌশলিক সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায় এটি পুরো অঞ্চলটির নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এ অঞ্চলে ভারতের সামরিক প্রস্তুতি একদিকে যেমন প্রতিরক্ষা সক্ষমতা জোরদারের অংশ, অন্যদিকে এটি একটি শক্ত বার্তাও। নয়াদিল্লি স্পষ্ট করে দিতে চাইছে যে, চীন বা অন্য কোনো রাষ্ট্র যদি এই করিডোরকে কৌশলগত দুর্বলতা হিসেবে বিবেচনা করে, তবে তা মোকাবেলায় ভারত প্রস্তুত। সামরিক পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে রাফাল স্কোয়াড্রনের মোতায়েন ছাড়াও রয়েছে S-400 প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। পাশাপাশি মাল্টি-জোন ডিটারেন্স ডকট্রিনের অংশ হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে অত্যাধুনিক রিয়েল-টাইম নজরদারি ব্যবস্থা (ISR), সাইবার ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধ সক্ষমতা এবং দ্রুত সমাবেশের জন্য প্রয়োজনীয় রাস্তা, টানেল ও রেল অবকাঠামো।
ভারতীয় সেনাবাহিনী মনে করছে, এখন আর কেবল সরাসরি সামরিক হুমকিই নয়, বরং ছায়াযুদ্ধ, প্রক্সি কৌশল এবং প্রযুক্তিনির্ভর সংঘাতের যুগে প্রবেশ করেছে দক্ষিণ এশিয়া। এই প্রেক্ষাপটে, শিলিগুড়ি করিডোরকে একমাত্র ‘লজিস্টিক করিডোর’ হিসেবে না দেখে ‘লাল রেখা’ হিসেবে বিবেচনা করছে নয়াদিল্লি।
এই পদক্ষেপগুলোর পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। চীন সম্প্রতি ভুটান সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে সামরিক মহড়া চালিয়েছে, যার ঢেউ লেগেছে ভারতের প্রতিরক্ষা মহলে। একই সময়কালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক গতিপথে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। দ্য এশিয়া লাইভের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ঢাকায় প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সম্ভাব্য উপস্থিতি ভারতকে চিন্তিত করেছে। নয়াদিল্লির আশঙ্কা, নতুন সরকার চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে পারে, যা ভারতের জন্য সরাসরি কৌশলগত হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সামরিক আধুনিকীকরণ প্রকল্পেও ভারতের চোখ আটকে আছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের ৩২টি জেএফ-১৭ থান্ডার যুদ্ধবিমান কেনার সম্ভাব্য পরিকল্পনার কথা জানাজানি হবার পর নয়াদিল্লির নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা ব্যাপক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই যুদ্ধবিমানগুলো চীন ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত এবং এতে রয়েছে অত্যাধুনিক AESA রাডার, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার (EW) পড এবং দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। যদি এগুলো উত্তরাঞ্চলে মোতায়েন করা হয়, তবে ভারতের সীমান্তবর্তী বিমানঘাঁটি এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো সরাসরি হুমকির মুখে পড়বে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, সম্প্রতি পাকিস্তানি একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসে গোয়েন্দা সহযোগিতা এবং সন্ত্রাসবিরোধী উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা করেছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। নয়াদিল্লি মনে করছে, এই আলোচনার পরপরই বাংলাদেশের সামরিক ক্রয় পরিকল্পনা সামনে আসা নিছক কাকতালীয় নয়। বরং দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নতুন জোট গঠনের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই ভারত এসব দেখছে।
এই অবস্থায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধির জয়সওয়াল একটি ব্যতিক্রমধর্মী বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “ভারত সীমান্তবর্তী অঞ্চলের ঘটনাবলি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং প্রয়োজন হলে সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে পিছপা হবে না।” এই বক্তব্যটি সরাসরি স্বীকারোক্তি বলেই মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। এই প্রথম নয়াদিল্লি প্রকাশ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করলো।
এদিকে উত্তর-পূর্ব ভারতে নিরাপত্তা বলয় জোরদারে চলছে নিরবচ্ছিন্ন ত্রি-সেবা সমন্বয় (ত্রি বাহিনী সংহতি)। ভারতের সামরিক বাহিনী এখন বাস্তবায়ন করছে একটি পূর্ণাঙ্গ স্ট্র্যাটেজিক গার্ডিং প্ল্যান, যার আওতায় ভারতীয় বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী যৌথভাবে পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত রক্ষা করবে। শিলিগুড়ি করিডোরে দ্রুত প্রতিরক্ষা বাহিনী মোতায়েনের জন্য চলছে কৌশলগত টানেল, রেল সংযোগ ও এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ।
সার্বিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি এখন এক জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। শিলিগুড়ি করিডোরে ভারতের সামরিক তৎপরতা কেবল একটি প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি নয়, বরং এটি একটি সুস্পষ্ট কৌশলগত ঘোষণা। একদিকে চীনের আগ্রাসী কৌশল, অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও পাকিস্তানের প্রভাব বিস্তার—সবকিছু মিলিয়ে ভারতের জন্য পূর্ব ফ্রন্ট এখন সবচেয়ে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ভূখণ্ডে পরিণত হয়েছে।
এই করিডোর এখন কেবল ভারতীয় ভূখণ্ড রক্ষার লাইন নয়, বরং এটি হয়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব ধরে রাখার শেষ লাইন—একটি অদৃশ্য কিন্তু স্পষ্টভাবে টানা লাল রেখা।