প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৫ | আজকের খবর অনলাইন |
সিলেটে কয়েকদিন ধরে অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণে জলাবদ্ধতা ক্রমেই প্রকট আকার ধারণ করছে। টানা বর্ষণে সিলেট নগরীর প্রধান সড়কগুলো থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লার অলি-গলিও তলিয়ে গেছে পানিতে। ফলে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন যাতায়াত ও জনজীবন একরকম অচল হয়ে পড়েছে। পানিতে ডুবে থাকা রাস্তায় যানবাহনের চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্ট খানাখন্দে জমে থাকা পানি দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষ করে শাহজালাল উপশহর, হাউজিং এস্টেট, মেন্দিবাগ, রেলগেইটসহ একাধিক এলাকায় ভোগান্তির চিত্র সবচেয়ে বেশি প্রকট।
নিম্নাঞ্চলে বসবাসকারী বহু মানুষ গতরাত কাটিয়েছেন নির্ঘুম। রেলস্টেশন, উপশহর, মদীনা মার্কেট, দরগাহ মহল্লা, পীর মহল্লা, শিবগঞ্জ, দক্ষিণ সুরমা, মেজরটিলা—এসব এলাকায় বাসাবাড়ি ও দোকানে পানি ঢুকে পড়েছে। এতে ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি চরম অসুবিধায় পড়েছেন এলাকাবাসী। অনেকেই ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার স্মৃতি মনে করে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছেন। তাদের আশঙ্কা, সে বছরের মতো পরিস্থিতি আবারো ফিরে আসতে পারে।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে সিলেটে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত বিরতিহীন বৃষ্টিপাত হয়। সিলেট আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, শুক্রবার ভোর ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ৮৭.৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এরপর মাত্র ৩ ঘণ্টায় আরও ৫৩ মিলিমিটার এবং সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৬১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়, অর্থাৎ মাত্র ৯ ঘণ্টায় ২০১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত ঘটে।
আবহাওয়াবিদদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, বৃষ্টিপাতের এই ধারা অব্যাহত থাকলে পাহাড়ি ঢল ও নদ-নদীর পানির উচ্চতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে পারে। বিশেষ করে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জ জেলার কিছু অংশে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ইতোমধ্যে এসব জেলায় সতর্কতা জারি করেছে এবং স্থানীয় প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সূত্রে জানা যায়, বঙ্গোপসাগরে যে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি প্রথমে লঘুচাপ, পরে সুস্পষ্ট লঘুচাপ, এরপর নিম্নচাপ এবং অবশেষে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়। বৃহস্পতিবার বিকেলে এটি বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করে স্থলভাগে উঠে আসে। যদিও পূর্বাভাসে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের নাম ছিল ‘শক্তি’, বাস্তবে তা ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়নি। আবহাওয়াবিদদের মতে, মৌসুমি বায়ু সময়ের আগেই বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং তা সক্রিয় থাকায় ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়নি।
ঘূর্ণিঝড় না হলেও এর প্রভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হয়েছে টানা বৃষ্টি ও দমকা হাওয়ার দাপট। এর ফলে সিলেটসহ অন্তত ১১টি জেলায় স্বল্পমেয়াদি বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের সারিগোয়াইন, যাদুকাটা, মনু, ধলাই, খোয়াই এবং সোমেশ্বরী নদীর পানি আগামী তিন দিনে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। ফলে নদী-সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়া, চট্টগ্রাম বিভাগের গোমতী, মুহুরী ও ফেনী নদীর পানি বাড়তে পারে এবং ফেনীর কিছু অংশে ক্ষুদ্রাকৃতির বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। একই সময়ে রংপুর বিভাগের তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলার নিম্নাঞ্চলগুলোতেও বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।
আবহাওয়ার এই বৈরী পরিস্থিতির ফলে শুধু সিলেট নয়, দেশের আরও অন্তত ১৪টি জেলার মানুষকে বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে অল্প সময়ের বৃষ্টিতেই সৃষ্ট দুর্ভোগ এখন ঘনঘনই ফিরে আসছে। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত পদক্ষেপ ও টেকসই অবকাঠামো উন্নয়নের দাবি জানাচ্ছেন নগরবাসী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহরের সড়ক ও নালা-নর্দমা ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ জলাবদ্ধতা ও বন্যার সম্মুখীন হতে পারে সিলেটসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল। এখনই সময় সতর্কতা ও প্রস্তুতির পাশাপাশি বাস্তবসম্মত নগর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের।