প্রকাশ: ২৪শে জুন, ২০২৫ | আজকের খবর ডেস্ক | আজকের খবর অনলাইন
বাংলাদেশে ‘মব সন্ত্রাস’ বা গণপিটুনি একটি নতুন ঘটনা নয়। এর ভয়াবহতা আমাদের অজানা না হলেও, প্রতিবার এর পুনরাবৃত্তি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের বিবেককে নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। গতকালের ঘটনার পর পুরো সামাজিক মাধ্যম উত্তাল। মানুষের ক্ষোভ, ঘৃণা, নিন্দা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। কিন্তু এই যে এখনকার প্রতিবাদ—এটা কি সবসময় সমানভাবে এসেছে? এমনকি তারা যারা এখন সোচ্চার, তারা কি সবসময়ই ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে’ মুখ খুলেছেন?
সম্প্রতি একটি ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত লেখাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র আলোড়ন তুলেছে, যেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এসেছে—নিন্দা কি আমরা বেছে বেছে করি? আমাদের বিবেক কি দল ও মতের সীমানায় আটকে যায়?
লেখাটিতে সরাসরি স্মরণ করা হয়েছে ২০১৮ সালের ২২ জুলাইয়ের ঘটনা, যখন কুষ্টিয়ায় সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান একটি মামলায় জামিন চাইতে গিয়েছিলেন। সেখানে আদালত চত্বরে তাঁকে ঘিরে ধরেছিল একদল উগ্র রাজনৈতিক কর্মী। তাঁকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়। তাঁর ওপর ছোঁড়া হয় ঘুষি, লাথি, ইট—চোখ-মুখ রক্তাক্ত হয়ে যায়। তাঁকে বের করে আনতে যে অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করা হয়েছিল, সেটিও আটকে রাখা হয়। অথচ সে সময় সামাজিক মাধ্যম, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজ এবং মানবাধিকারের বড় বড় মুখপাত্রদের কাছ থেকে কোনো ন্যূনতম প্রতিবাদও ওঠেনি। বরং অনেকেই তখন উৎসাহীভাবে এই সহিংসতা উপভোগ করেছেন—শেয়ার করেছেন, হাস্যরস করেছেন, বিকৃত উল্লাস করেছেন।
মাহমুদুর রহমান ছিলেন না কোনো ক্ষমতাবান শাসক, নন কুখ্যাত আমলা কিংবা নীরব দোসর। তিনি ছিলেন সরকারের কঠোর সমালোচক, ছিলেন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ। অথচ তাঁর রক্তাক্ত মুখ, আদালতের রাস্তায় নিঃসহায় পড়ে থাকা একটি মানুষের দৃশ্য কেউ মনে রাখেনি।
তবে শুধু মাহমুদুর রহমান নন—স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে আরও কিছু ঘটনার কথা। দৈনিক সংগ্রামের প্রবীণ সম্পাদক আবুল আসাদের ওপর হামলা, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে চট্টগ্রামে উদোম করে দেওয়া, কিংবা বেগম খালেদা জিয়ার ওপর বাংলামোটর ও ফেনীতে বর্বর হামলার ঘটনা—সবই এ দেশের রাজনীতিতে ঘটেছে, সবার চোখের সামনে। কিন্তু তখন প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পায়নি অনেকেই। বিবেক যেন হয়ে পড়েছিল রাজনৈতিক পক্ষপাতের কাছে বন্ধক।
লেখাটিতে এও বলা হয়েছে, যারা অতীতে ফ্যাসিবাদের জোটবদ্ধ রাজনীতির সহযাত্রী ছিলেন, গণতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নকে সমর্থন করেছেন, তারাই এখন ‘মব সন্ত্রাস’ নিয়ে প্রলাপ করছেন, যেন নিজেদের অতীতের পাপ ধুয়ে ফেলতে চান কয়েকটি ফেসবুক পোস্ট বা টুইট দিয়ে।
এই দ্বৈত আচরণ শুধু রাজনৈতিক সুবিধাবাদ নয়, এটি সমাজের নৈতিক ভিত্তিকে ক্ষয়ে দেওয়ার এক ভয়াবহ চিত্র। আজ যারা নিন্দা করছেন, তারা যদি সেদিন নীরব না থাকতেন, তবে হয়তো ‘মব সন্ত্রাস’ আমাদের রাষ্ট্রে এতটা প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে উঠত না।
এখানে কথা হচ্ছে ন্যায়ের পক্ষ নেওয়ার, কিন্তু সেটা যদি দলীয় ঘেরাটোপে আবদ্ধ হয়—তবে তা আর ন্যায় থাকে না, থাকে কেবল প্রচার। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে লড়াইয়ের কথা বলা হচ্ছে, সেটি যদি একপাক্ষিক হয়, তবে তা গণতন্ত্রের মুখোশ পরে আসা আরেক ধরনের শোষণ।
আজ যারা নিজেদের নৈতিক উচ্চতায় স্থাপন করে অন্যদের মুখ বন্ধ করতে চান, তাদের উচিত আয়নায় নিজেদের অতীত মুখোমুখি হওয়া। কারণ ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো এক দিনের কাজ নয়, এটি দীর্ঘ পথচলা—যেখানে সুযোগে চুপ থেকে পরবর্তীতে নাটকীয় প্রতিক্রিয়া দেখানো কেবল দ্বিচারিতাকেই প্রতিফলিত করে।
আমাদের সমাজ, গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক চর্চায় এখন জরুরি একটি বিষয়—সাংবিধানিক ও মানবিক মূল্যবোধে ফিরে যাওয়া। আইন হাতে তুলে নেওয়ার সংস্কৃতি যদি একবার সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়, তা আর কোনো দল বা মত দেখে না, কেবল ধ্বংসই ডেকে আনে।
এই কারণেই ‘মব সন্ত্রাস’ সবসময়ই নিন্দনীয়—তা যার বিরুদ্ধেই হোক, যেখানেই হোক। যারা সত্যিকার অর্থেই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন, তাদের অধিকার আছে সমালোচনা করার। তবে যারা অতীতে চুপ থেকেছেন, সহিংসতার পক্ষে মৌন সম্মতি দিয়েছেন, তাদের উচিত অন্তত এখন ন্যায়ের বার্তাকে রাজনৈতিক অস্ত্র না বানানো। নইলে আমাদের প্রতিবাদও হয়ে দাঁড়াবে আরেকটি বেছে নেওয়া বিভাজনের নামমাত্র মুখোশ।