শিরোনাম :
শেখ হাসিনার বিচার শুরু হয়েছে, দলীয়ভাবেও আওয়ামী লীগের বিচার হওয়া উচিত: মির্জা ফখরুল উত্তরের অচেনা বিস্ফোরণ: লেবাননে ইসরাইলি ড্রোন হামলায় নিহত ৩, আহত ১৩ কারামুক্তির পর পর্দায় ফেরার বার্তা: ‘জ্বীন-৩’ দিয়ে ফিরলেন নুসরাত ফারিয়া জামায়াতের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ চীন সফরে জাতীয় সমাবেশে জামায়াতের বার্তা: ৭ দফা দাবিতে বড় গণসমাবেশের প্রস্তুতি বাস রুট পারমিট নিয়ে ঢাকার পরিবহন খাতে অস্থিরতা, সিদ্ধান্তহীনতায় আরটিসি বরিশালে টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা, অচল জনজীবন নিঃসঙ্গ জীবনের করুণ পরিণতি: পাকিস্তানে অভিনেত্রী হুমাইরা আসগরের পচনধরা লাশ উদ্ধার ব্যাটিং বিপর্যয়ে সিরিজ হাতছাড়া, হতাশ মিরাজ জানালেন ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা পুনরায় মহাসংঘর্ষ: রিয়াল-পিএসজির দ্বৈরথে আজ ইতিহাস লিখবে কে?

উপনিবেশের রক্তাক্ত ইতিহাস: ফ্রান্সের মুসলিম-বিরোধী নির্মমতা ও উপমহাদেশের বিস্মৃত শিক্ষা

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ২২ জুন, ২০২৫
  • ৭২ বার

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫ | আজকের খবর ডেস্ক | আজকের খবর অনলাইন

ইতিহাস কেবল পাণ্ডুলিপার পাতায় বাঁধা কোনো পুরাতন কথা নয়। ইতিহাস কখনো কখনো জ্বলন্ত আগুনের মতো জীবন্ত, যা জাতির আত্মপরিচয় ও চেতনায় ক্ষত হয়ে থাকে। ইউটিউবে প্রকাশিত একটি ভিডিও এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় সংবাদমাধ্যম, একাডেমিক গবেষণা ও দলিলভিত্তিক প্রকাশনার আলোকে সম্প্রতি আবার সামনে এসেছে ফরাসি ঔপনিবেশিক যুগের নির্মম ও রক্তক্ষয়ী ইতিহাস—বিশেষত আফ্রিকার মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত ভয়াবহ দমন-পীড়ন, গণহত্যা ও সাংস্কৃতিক ধ্বংসযজ্ঞ।

বিশেষ করে আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো, চাদ ও মিশরের মতো মুসলিমপ্রধান অঞ্চলে ফ্রান্সের শতাধিক বছরের ঔপনিবেশিক শাসন এক ঘৃণ্য অধ্যায় হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়। উপমহাদেশের মানুষ এই ইতিহাস জানে না বলেই হয়তো আজও পশ্চিমা ‘সভ্যতা’ এবং ‘উন্নত রুচিবোধ’ নিয়ে মুগ্ধ হয়ে ফ্রান্সের পক্ষে অবস্থান নিতে দ্বিধা করে না অনেক মুসলিম নাগরিক।

১৯১৭ সালে ফ্রান্স আফ্রিকার চাদ অঞ্চল পুরোপুরি দখল করে। চাদের স্থানীয় মুসলিমদের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় শিক্ষা-সংস্কৃতির নেতৃত্বে ছিলেন বহু আলেম ও ধর্মীয় নেতা। ফরাসি বাহিনী এই প্রভাবকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। ঐতিহাসিক দলিল ও চাদের মুখে-মুখে প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী, ফরাসি সেনারা ৪০০ মুসলিম আলেমকে একত্র করে তাদের গলা কেটে নির্মমভাবে হত্যা করে, যাতে ইসলামী নেতৃত্ব পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়। এই হত্যাযজ্ঞ হয়েছিল একটিই উদ্দেশ্যে—চাদের মুসলমানরা যেন কখনো আর স্বাধীনতার দাবি তুলতে না পারে।

ফ্রান্স আলজেরিয়াকে দখল করে ১৮৩০ সালে এবং তা চলতে থাকে ১৩২ বছর ধরে। দখলের প্রথম সাত বছরেই ফরাসিরা প্রায় ১০ লাখ মুসলমানকে হত্যা করে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফরাসি ইতিহাসবিদ জ্যাক গোরকি তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ১৮৩০ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ফ্রান্স আলজেরিয়ায় মোট ১ কোটি মুসলমানকে হত্যা করেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের (১৯৫৪–১৯৬২) শেষ সাত বছরে ফরাসি বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে আরও প্রায় ১৫ লাখ মানুষকে, যার মধ্যে নারী, শিশু এবং বেসামরিক জনগণ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ।

সবচেয়ে হৃদয়বিদারক এবং চরম মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি হলো—ফ্রান্স কর্তৃক আলজেরিয়ায় পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৬ সালের মধ্যে ফরাসি সরকার দক্ষিণ আলজেরিয়ার সাহারা মরুভূমিতে ১৭টি পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়।

ফরাসি সামরিক নথি ও আলজেরিয়ান গবেষণা অনুসারে, এসব পরীক্ষার কারণে ২৭ হাজার থেকে ১ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। আক্রান্ত মানুষদের অনেকেই ক্যানসার, জন্মগত ত্রুটি ও তেজস্ক্রিয় বিকিরণজনিত অসুস্থতায় দীর্ঘদিন ভুগে মারা যান। আজও আলজেরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে এর প্রভাব স্পষ্ট: ভুক্তভোগী শিশুদের জন্মগত অঙ্গবিকৃতি, মৃতপ্রসূতি হার ও ক্যানসারের প্রকোপ আশঙ্কাজনক হারে বেশি।

১৯৬২ সালে যখন ফ্রান্স আলজেরিয়া ছাড়ে, তখন তারা দেশটির বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে রেখে যায় এক মরণফাঁদ—প্রায় এক কোটি ভূমিমাইন। বিস্ফোরকযুক্ত এসব মাইন কোনো ম্যাপ বা দিকনির্দেশনা ছাড়াই মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়, যাতে স্বাধীন আলজেরিয়ার জনগণ বহু দশক পর্যন্ত সেসব নিষ্ক্রিয় করতে না পারে।

এই মাইন বিস্ফোরণে ১৯৬২ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত লক্ষাধিক শিশু ও কৃষক মারা যান বা পঙ্গু হন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ এই কর্মকাণ্ডকে “মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ” হিসেবে অভিহিত করেছে।

১৮৫২ সালে আলজেরিয়ার লগওয়াত শহরে প্রবেশ করে ফরাসি সেনাবাহিনী। ঐ রাতে শহরের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। শহরের ঘরবাড়ি, বাজার ও মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় এবং বেঁচে থাকা মানুষদের ধরে ধরে প্রকাশ্যে গুলি করা হয়। এই বর্বরতা ইতিহাসে ‘সাহারা উপত্যকার নারকীয় রাত্রি’ নামে পরিচিত।

ফ্রান্সের মুসলিমবিরোধী মনোভাব কেবল অতীতে সীমাবদ্ধ ছিল না। নেপোলিয়নের মিশর অভিযান (১৭৯৮)-এ ফরাসি সেনারা মসজিদে ঢুকে ঘোড়া বেঁধে রাখে, সেখানে বসে মদ পান করে এবং নারীদের ধর্ষণ করে পরিবারের সামনেই।

কিছু কিছু ঐতিহাসিক বর্ণনায় বলা হয়েছে, তারা ইসলামের পবিত্র স্থানগুলোকে ‘তামাশার মাঠে’ পরিণত করেছিল। এমনকি কায়রোর কিছু মসজিদকে ঘোড়ার আস্তাবল বানানো হয়। এরপরও আজকের ফরাসি গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ইসলামকে “সন্ত্রাসের ধর্ম” হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে এবং আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ চালিয়ে যায়।

ফ্রান্সের মুসলিম-বিরোধী দমননীতি শুধু আলজেরিয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল না।
তারা তিউনিসিয়াকে ৭৫ বছর, মরক্কোকে ৪৪ বছর, এবং মৌরিতানিয়াকে ৬০ বছর ধরে শাসন করেছে। এই সব অঞ্চলেই তারা একই কৌশলে মুসলিম সংস্কৃতি, ভাষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। স্থানীয় শিক্ষাব্যবস্থার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল ধর্মহীন পাশ্চাত্য ধ্যানধারণা এবং মুসলিম নেতৃত্বদের বদলে বসানো হয়েছিল পশ্চিমা ভাবাদর্শে দীক্ষিত কূটনীতিকরা।

ফরাসি উপনিবেশের এই রক্তাক্ত ইতিহাস জানা থাকার পরেও, আজ অনেক তথাকথিত ‘উন্নত রুচির’ সুশীল নাগরিক দেখা যায় যারা ‘ফ্রান্সের সভ্যতা’ ও ‘শৈল্পিকতা’ নিয়ে গর্ব করেন। ফ্রান্সের পণ্য, সিনেমা, সাহিত্য বা রাজনীতিকে তারা নিজেদের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে গণ্য করেন। কিন্তু তারা ভুলে যান, এই দেশটিই মুসলিম ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুর দমনযজ্ঞ ও সাংস্কৃতিক ধ্বংসযজ্ঞের জন্য দায়ী।

বিশ্ব রাজনীতির বাস্তবতা বুঝতে হলে ইতিহাস জানতে হবে। মুসলিম বিশ্বের জন্য ফ্রান্স কেবল একটি উন্নত রাষ্ট্র নয়, বরং এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের নাম—যেখানে অগণিত মুসলমান রক্তের নদীতে ভেসে গেছে শুধুমাত্র নিজেদের ধর্মবিশ্বাস ও স্বাধীনতার অধিকারের জন্য।

আজ যখন ইসলামকে সন্ত্রাসের ধর্ম হিসেবে চিত্রিত করতে চায় পশ্চিমা বিশ্ব, তখন মুসলিম সমাজের কর্তব্য ইতিহাস জানার মাধ্যমে আত্মপরিচয়ের ভিত্তি শক্ত করা। কারণ ইতিহাস জানলেই বোঝা যায়, কারা আসলে সন্ত্রাস ছড়িয়েছে, আর কারা তার বিরুদ্ধে শহীদ হয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

এ জাতীয় আরো খবর..

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২৫