প্রকাশ: আজকের খবর অনলাইন | ২ জুন ২০২৫ | নিজস্ব সংবাদদাতা
বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কাজটি স্বাধীনতা যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই করা উচিত ছিল, তা অবশেষে শুরু হয়েছে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের হাত ধরে। রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত নীতিমালায় আসছে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার, যার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে নিজস্ব সামরিক সক্ষমতা গড়ে তোলার প্রকল্প।
সম্প্রতি বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর নির্বাহী সদস্য আশিক চৌধুরী তুরস্ক সফরে দেশটির অস্ত্র শিল্প অবকাঠামো পরিদর্শন করেন। সফরের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের মাটিতে একটি আত্মনির্ভরশীল প্রতিরক্ষা উৎপাদন শিল্প গড়ে তোলার লক্ষ্যে তুরস্কের সহযোগিতা নিশ্চিত করা। আলোচনায় এসেছে অস্ত্র তৈরির প্রযুক্তি স্থানান্তর, কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং যৌথ উদ্যোগে স্থাপনা নির্মাণের সম্ভাবনা।
স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ এখনও প্রতিরক্ষায় শতভাগ বিদেশনির্ভর। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার এই চিত্র বদলে দিতে চায়। এ উদ্যোগ শুধু প্রতিরক্ষার জন্য নয়, বরং শিল্পায়ন, রপ্তানি, কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তি জ্ঞান বৃদ্ধির দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
এদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অঞ্চলভিত্তিক বাণিজ্যের প্রসারে সরকার বন্দর সম্প্রসারণ, করিডোর উন্নয়ন এবং একাধিক অবকাঠামো প্রকল্পে হাত দিয়েছে। কিছু রাজনৈতিক মহল এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্য থেকে এ নিয়ে আপত্তি ওঠায় নানা গুঞ্জন তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব আপত্তি বাস্তবভিত্তিক নীতির পরিবর্তে ভূ-রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার প্রতিফলন।
অতীত সরকারের সময়ে ভারতের সঙ্গে কিছু চুক্তি ও করিডোর সুবিধা নিয়ে আলোচনা হলেও, অনেক চুক্তির পরিণতি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমান সরকার সেই জায়গাগুলোতে স্বচ্ছতা ও লাভজনক ভারসাম্য আনার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে করিডোর ব্যবস্থাপনায় পারস্পরিক সুবিধা বজায় রেখে ট্রানজিটের জন্য ন্যায্য ফি আদায়, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমতার প্রশ্নে কোনো আপস না করেই নীতিমালা গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
অর্থনৈতিক কাঠামোর সংস্কারেও ইতোমধ্যে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় গৃহীত হয়েছে কিছু কাঠামোগত সিদ্ধান্ত, যার মধ্যে রয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, দুর্বল কোম্পানিগুলোর পুনর্গঠন এবং নতুন আইনী কাঠামোর খসড়া তৈরি।
এইসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের পথে সরকার যেমন প্রতিরোধের মুখে পড়ছে, তেমনি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে আশাবাদী সাড়া পাচ্ছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এসব সংস্কার পরিকল্পনার ফলে বাংলাদেশের আর্থিক খাত একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে এবং দীর্ঘমেয়াদে তা জাতীয় অর্থনীতিকে গতি দেবে।
তবে এসব পরিবর্তনের বিরুদ্ধে একাংশের অসন্তোষ স্পষ্ট। কেউ কেউ তা ‘সংস্কার বিরোধিতা’ নয় বরং ‘আধিপত্য ও সুবিধা হারানোর ভয়’ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন। অতীতে অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলা অনিয়ম এখন নতুন নীতিমালায় হুমকির মুখে পড়েছে। স্বভাবতই সেখানে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া—যেখানে প্রতিষ্ঠিত সুবিধাবাদীরা পরিবর্তনের বিরুদ্ধে মুখ খুলবে, কিন্তু জাতীয় স্বার্থে এগুলো ঠেকানো উচিত নয়।
এদিকে দেশের তরুণ সমাজ, বিশেষত ছাত্রজনতা—যারা জুলাই আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে, তারা এখন জাতীয় স্বার্থে একাত্ম হওয়ার বার্তা দিচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় অনেকেই বলছেন, ব্যক্তি বা দল নয়, দেশকেই সর্বাগ্রে রাখা দরকার।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও মতপার্থক্য বিদ্যমান থাকলেও, একটি সমন্বিত জাতীয় ঐক্য গঠনের দাবি উঠছে নানা মহল থেকে। অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও প্রতিরক্ষা নীতির প্রশ্নে রাজনীতি থেকে উর্ধ্বে উঠে একটি সমন্বিত কৌশলপত্র তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বিশ্লেষকেরা।
পরিশেষে বলা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছরের পথচলায় অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বা অর্ধসমাপ্ত থেকে গেছে। এখন সেই কাজগুলোকে সুসংহত ও বাস্তবায়নযোগ্য রূপে পরিণত করার সময় এসেছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের এই পদক্ষেপগুলি নতুন যুগের সূচনাবিন্দু হয়ে থাকতে পারে। তবে এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐক্য, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও সাধারণ মানুষের সচেতন অংশগ্রহণ।