শিরোনাম :
ইরানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে চায় ইসরায়েল: প্রতিবেদন তেহরানের হৃদয়ে অপারেশন: ইরানের গভীরে ইসরায়েলের নিখুঁত হামলার পেছনের গোয়েন্দা কৌশল উদ্ঘাটন হাইফা বন্দরে ইরানের হামলা: মোদির আদানি খাতায় ‘আগ্নেয়’ ক্ষতির হিসাব শুরু! ১৪ বছরের জর্জ স্টিন্নি: ইতিহাসের নৃশংস বিচারবিভাগীয় হত্যাকাণ্ড ইরান দাবি করল ১৩টি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত: যুদ্ধক্ষেত্রের পাল্টা ভারসাম্য না কি মধ্যপ্রাচ্যীয় ভূরাজনীতির নতুন মোড়? মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ-ভূমিতে ইরান-ইসরাইল সংঘর্ষ: কূটনৈতিক চাপ, সামরিক বাস্তবতা ও বাংলাদেশের করণীয় সিলেটে উপদেষ্টা বহর আটকে ক্ষুব্ধ জনতার বিক্ষোভ দেশে ফিরলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস তারেক রহমান ও অধ্যাপক ইউনূসের বৈঠক ঘিরে ভূরাজনৈতিক বার্তা: ভারতের ভূমিকা নিয়ে শঙ্কা ও আঞ্চলিক সমীকরণে নতুন মোড় ইরানের সেনাপতি বাঘেরির হত্যাকাণ্ড: মধ্যপ্রাচ্যে বিস্ফোরণমুখী উত্তেজনা, বিশ্ব কি বৃহৎ যুদ্ধে ধাবিত হচ্ছে?

ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও হত্যার অভিযোগে ঘেরা বরখাস্ত ওসি প্রদীপ: ‘ক্রসফায়ারের’ আড়ালে টেকনাফে ছিল মানবতা লঙ্ঘনের এক কালো অধ্যায়

নিজস্ব সংবাদদাতা
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ২ জুন, ২০২৫
  • ১৪ বার

আজকের খবর অনলাইন | প্রকাশ: ২ জুন ২০২৫ | নিজস্ব সংবাদদাতা

মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার ও বরখাস্ত হওয়া টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এখন আর শুধু একটি হত্যা মামলার আসামি নন—তাঁর বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে ভয়াবহ সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য। র‍্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে এমন কিছু বিস্ফোরক তথ্য, যা নতুন করে কাঁপিয়ে তুলেছে জাতীয় বিবেককে।

তদন্ত ও ভুক্তভোগীদের বর্ণনায় প্রকাশ পেয়েছে, ওসি প্রদীপ কুমার দাশ শুধু ‘ক্রসফায়ার’র নামে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেননি, বরং ক্ষমতার অপব্যবহার করে নারী ধর্ষণ, ইয়াবা সংক্রান্ত সাজানো মামলা, এবং চাঁদাবাজির মতো অপরাধেরও কুশীলব ছিলেন। তার ‘অভিযোগের খাতা’তে এখন যুক্ত হয়েছে নারীর সম্ভ্রমহানির ভয়াবহ ইতিহাস—যা টেকনাফ থানাকে পরিণত করেছিল এক নিষ্ঠুর নির্যাতনকেন্দ্রে।

টেকনাফের ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগ অনুযায়ী, মাদক কারবারের অভিযোগের আড়ালে ওসি প্রদীপ ও তাঁর সহযোগীরা গড়ে তুলেছিলেন ধর্ষণ-নির্যাতনের একটি অব্যাহত চক্র। নারী নির্যাতনের এসব ঘটনা এতটাই প্রকট যে, ভুক্তভোগীদের দাবি, অন্তত ৫০ জন নারীকে তিনি ‘ইয়াবা কারবারি’ সাজিয়ে আটক করে থানা হেফাজতে ধর্ষণ করেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই পরিবার থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করেও মুক্তি দেননি। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, ‘ক্রসফায়ার’-এর ভয় দেখিয়ে দিনের পর দিন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তাঁরা।

নাজিরপাড়া এলাকার এক নারী জানান, তাঁর স্বামীকে তুলে নিয়ে ৪৫ লাখ টাকা দাবি করেন ওসি প্রদীপ। তিন লাখ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে থানায় গেলে তাকে তিন দিন আটকে রেখে প্রদীপসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য মিলে ধর্ষণ করে। এরপর বলা হয়, স্বামীকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু পরদিনই স্বামীর গুলিবিদ্ধ মরদেহ পাওয়া যায়। এরপরও ওই নারী মুখ খুলতে পারেননি, কারণ প্রদীপ হুমকি দিয়েছিলেন—মুখ খুললেই পুরো পরিবারকে গুলি করে হত্যা করা হবে।

আরও ভয়াবহ অভিযোগ এসেছে উখিয়ার কোর্ট বাজার এলাকার এক নির্যাতিতা তরুণীর পরিবার থেকে। জানা গেছে, ২০১৯ সালের শেষের দিকে কলেজপড়ুয়া মেয়েটি প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়। পরে প্রদীপ কুমার দাশ সেই মামলার দায়িত্ব নিয়ে অভিযুক্তদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ গ্রহণ করেন এবং নিজেও মেয়েটিকে থানায় আটকে রেখে ধর্ষণ করেন। পরে ইয়াবা দিয়ে সাজানো মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয় তরুণীকে।

একইভাবে ২০২০ সালে কোর্ট বাজার এলাকার দুই কিশোরীকে অস্ত্র ঠেকিয়ে বাড়ি থেকে তুলে এনে থানার দ্বিতীয় তলায় দীর্ঘদিন আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়। এরপর তাঁদেরও মাদকের মামলায় ফাঁসিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। ছাড়া পাওয়ার পর এই দুই কিশোরী আত্মহত্যার চেষ্টা করে।

প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তখন গোপন থাকলেও মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডে তাঁর গ্রেপ্তারের পর পুরনো দুঃসহ স্মৃতি আর নীরবে থাকতে পারেনি অনেক ভুক্তভোগী পরিবার। কিন্তু এক সময়ের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ‘শ্রেষ্ঠ অফিসার’ হিসেবে যাকে প্রশংসা ও পদকে ভূষিত করা হয়েছিল, সেই মানুষটির বিরুদ্ধে এত গুরুতর অপরাধের অভিযোগ এখন গোটা আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

প্রদীপ কুমার দাশকে বারবার পুরস্কৃত করা হয়। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে তিনি পেয়েছেন পুলিশের সর্বোচ্চ সম্মান “বাংলাদেশ পুলিশ পদক” (বিপিএম)। এর আগেও তিনি একাধিকবার রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম) অর্জন করেন। এমনকি তাঁকে চারবার “চট্টগ্রাম রেঞ্জের শ্রেষ্ঠ ওসি” হিসেবেও ঘোষণা দেওয়া হয়। আজ এসব স্বীকৃতিই প্রশ্নবিদ্ধ।

২০২১ সালের জুন মাসে আদালতে প্রদীপের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাঁর আইনজীবী রানা দাশ গুপ্ত দাবি করেছিলেন, তাঁর মক্কেল ‘মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির ধারক’, এবং তিনি মাদক নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে মাদক আবারও বাড়ছে বলেও দাবি করেছিলেন তিনি। মেজর সিনহার গলায় বুট চেপে হত্যার যে অভিযোগ রয়েছে, তা ময়নাতদন্তে পাওয়া যায়নি বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন ছবি তুলে ধরে। ‘জিরো টলারেন্স’ বা মাদকবিরোধী অভিযান যে কতটা নির্মম, বিভৎস ও অনৈতিক হতে পারে—তার বাস্তব রূপই যেন ছিলেন প্রদীপ। আজ যখন একের পর এক ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও সাজানো ক্রসফায়ারের অভিযোগ উঠে আসছে, তখন এই প্রশ্নও উঠছে—তাঁকে এতদিন ধরে রাষ্ট্রীয় ছায়া দিয়ে কারা তাঁকে দায়মুক্তি দিয়ে চলছিল?

প্রদীপ আমলের তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ছিল ১৬১ জন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগ রয়েছে, এই হত্যা ছিল সাজানো। কোনো প্রমাণ ছাড়াই মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হতো। অনেক সময় মুক্তিপণের টাকা দিয়েও জীবন রক্ষা করা যেত না। যারা টাকা দিতে পারেনি, তারা প্রাণ হারিয়েছে।

প্রশ্ন জাগে—এসব নারকীয় ঘটনা ঘটার পরও কেন এতদিন প্রদীপের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের অভিযোগগুলো আইনি প্রক্রিয়ায় আসেনি? মূল কারণ, ভয় এবং হুমকি। প্রদীপের হাতে ছিল অস্ত্র, ছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, এবং ছিল একটি অদৃশ্য ছত্রছায়া। কেউ মুখ খুললেই পুরো পরিবার নিশ্চিহ্ন করে ফেলার হুমকি দেওয়া হতো।

আজ সেই আতঙ্ক কমলেও ক্ষত শুকায়নি। এখন সময়—এই অভিযোগগুলো নতুন করে আমলে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত নিশ্চিত করা। শুধু মেজর সিনহা হত্যায় সাজা দেওয়া নয়, বরং প্রদীপের সম্পূর্ণ অপরাধ-চক্র, বিশেষ করে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনাগুলো যথাযথ তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করাই হতে হবে রাষ্ট্র ও বিচারব্যবস্থার নৈতিক দায়িত্ব।

প্রদীপ কুমার দাশ ছিল না শুধু একজন বরখাস্ত ওসি—সে ছিল রাষ্ট্রের নামে, মানুষের নামে এক ভয়াবহ প্রতারণার নাম। এই অধ্যায় থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে এমন কেউ যেন আর রাষ্ট্রের ছায়ায় নৃশংসতা চালাতে না পারে—সেটাই আজকের বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অঙ্গীকার হওয়া উচিত।

নিউজটি শেয়ার করুন..

এ জাতীয় আরো খবর..

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২৫