প্রকাশ: ২৭শে জুন, ২০২৫ । আজকের খবর ডেস্ক | আজকের খবর অনলাইন
বর্ষা আসতেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাপে কাটার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। সাপ নিয়ে আমাদের সমাজে বহু বিভ্রান্তি, কুসংস্কার এবং সিনেমার গল্পের মতো অলৌকিক ধারণা প্রচলিত রয়েছে—যার ফলে অনেক মানুষ সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নিয়ে বিপদে পড়েন বা প্রাণ হারান। অথচ, সত্যিকারের তথ্য জানা থাকলে এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সাপে কাটা মানুষ প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই বেঁচে যেতে পারে।
সিনেমা-নাটকে দেখা যায়, বীন বাজালে সাপ নাচে, দুধ খেতে আসে, সঙ্গীর প্রতিশোধ নেয়—বাস্তবে এসব কিছুই সত্য নয়। সাপ বীনের আওয়াজে নয়, তার নড়াচড়ার প্রতিক্রিয়ায় মাথা দোলায়। কারণ, সাপের কানে শ্রবণশক্তি নেই। তারা পরিবেশের কম্পন ও স্পর্শের মাধ্যমে চারপাশ বুঝে। মানুষের চলার আওয়াজ, ধাপের কম্পনেই সাপ বুঝতে পারে—একটি বড়দেহী প্রাণী তার দিকে আসছে, তখনই সে পালিয়ে যায়।
সুগন্ধি ফুল যেমন বেলি, হাস্নাহেনা কিংবা গন্ধরাজ সাপ টানে না। এসব ফুলে পোকামাকড় আসে, সেই পোকা খেতে ব্যাঙ আসে, এবং ব্যাঙ খেতে মাঝেমধ্যে সাপ আসতে পারে। ফুল নয়, খাবারই মূল আকর্ষণ। আর মানুষের উপস্থিতি পেলে অধিকাংশ সাপই এলাকা ত্যাগ করে।
অনেকে মনে করেন, একটি সাপ মারলে তার সঙ্গী প্রতিশোধ নিতে আসে। বিজ্ঞান বলছে, এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সাপের স্মৃতিশক্তি দুর্বল, প্রতিশোধপরায়ণতা এদের আচরণে নেই। একাধিক সাপ দেখা গেলে বুঝতে হবে, এটি স্রেফ মেটিং সিজন, আশেপাশে গর্ত রয়েছে অথবা তাদের উপস্থিতি কাকতালীয়।
আরেকটি ভয়ঙ্কর ভুল হলো “ছোট সাপে বিষ নেই।” সাপের বাচ্চাও বিষাক্ত হতে পারে। চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এক ইঞ্চির কেউটের কামড়েও আইসিইউতে রোগী ভর্তি হয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছেন। চিকিৎসা ব্যয় এমনকি এক রাতেই বিশ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অথচ, এমন রোগীদের অনেকেই দারিদ্র্যের কারণে জানতেও পারেন না, তাদের বাঁচাতে কী খরচ হয়েছে।
বিশেষত জেলেদের মধ্যে সাপে কাটার ঝুঁকি বেশি। বর্ষাকালে নদী-খালে জাল ফেলতে গিয়ে কিংবা শিক ধরতে গিয়ে তারা ভুল করে গর্তে থাকা সাপের মুখোমুখি হয়। অনেকে ভেবে নেয়, সাপ দুধ খেতে আসে বা গোলাঘরে হামলা চালায়। বাস্তবে, সাপের খাদ্যতালিকায় দুধের কোনো স্থান নেই। তারা ব্যাঙ, পোকামাকড়, ইঁদুর এসবই খায়। ক্ষেতের দাড়াশ সাপ যেমন বিষহীন, তেমনই কৃষকদের উপকারে আসে।
আরও এক প্রচলিত ভুল হলো—সাপে কাটলে ব্লেড দিয়ে কেটে দেওয়া, বিষ চুষে ফেলা, বা গরম লোহার ছ্যাঁকা দেওয়া। এসব “দেশি চিকিৎসা” স্রেফ ভ্রান্ত ধারণা। বরং এতে রক্তে বিষ দ্রুত ছড়ায়, সংক্রমণ ঘটে এবং অঙ্গহানিও হতে পারে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, সাপে কাটলে প্রথম কাজ—অহেতুক ভয় না পাওয়া। আক্রান্ত অঙ্গের নড়াচড়া একদম কমিয়ে ফেলা, ঢিলে করে কাপড় পেঁচানো (যাতে রক্ত চলাচল থেমে না যায়), দ্রুত কাছের সরকারি হাসপাতালে যাওয়া এবং প্রয়োজন হলে অ্যান্টিভেনম গ্রহণ—এটাই জীবনরক্ষাকারী পথ। ভুলেও লোহার তার, সুতলি বা ইলেকট্রিক তার দিয়ে বাঁধবেন না। সাপে কাটলে সঙ্গে থাকা আংটি, চুড়ি, ব্রেসলেট খুলে ফেলুন। কারণ ফুলে গেলে তা রক্ত চলাচল বন্ধ করে অঙ্গপচনের কারণ হতে পারে।
আরও গুরুত্বপূর্ণ, বিষাক্ত সাপের কামড়ের লক্ষণ বোঝার চেষ্টা করা। যেমন, দুইটি গভীর দাঁতের দাগ, ঝিমধরা ভাব, চোখের পাতা ভারী হওয়া, ঝাপসা দেখা, শ্বাসকষ্ট, বমি, অঙ্গসঞ্চালনে অক্ষমতা ইত্যাদি হলে বুঝতে হবে, এটি বিষাক্ত সাপের কামড়। আবার চন্দ্রবোড়া নামক সাপের কামড়ে রক্তক্ষরণ, ফুলে যাওয়া, এমনকি কিডনি বা হার্ট ফেইলিওরও হতে পারে।
তবে একটা সত্য—সব সাপ বিষাক্ত নয়। বাংলাদেশে প্রায় ৮০ ধরনের সাপ রয়েছে, তার মধ্যে মাত্র ৫-৬টি বিষধর। অথচ অজ্ঞতার কারণে নির্বিষ সাপও বহুবার মানুষের হাতে মারা পড়ে। পরিবেশবিদরা বলছেন, এটি ভয়াবহ ইকোলজিক্যাল ক্ষতির কারণ হতে পারে। সাপ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সাপে কাটলে প্রথমে যে ভুল করা হয় তা হলো—ওঝার কাছে যাওয়া। এরা স্রেফ ভণ্ড। চিকিৎসা করতে পারে না। যারা বাঁচে, তারা এমনিতেই নির্বিষ সাপে কাটা বা ভয়ের কারণে আসা রোগী। অনেককে আমরা হাসপাতালে পাই যখন তারা আর বাঁচার অবস্থায় থাকে না। সাপে কাটলে একমাত্র সঠিক পথ—চিকিৎসা কেন্দ্র।
বর্ষাকাল সাপের আবাসভূমি বদলানোর সময়। তাদের গর্তে পানি ঢুকে যাওয়ায় তারা আশ্রয় খুঁজতে উঠে আসে মানুষের ঘরে, তোশকে, আলনায়, কাঠের স্তূপে বা রান্নাঘরের কোণায়। তাই এখনই সময় সতর্ক হবার। বাড়ির ঝোপঝাড় পরিষ্কার করুন, খড় বা কাঠের গাদায় আগে লাঠি দিয়ে শব্দ করুন। ছোটদের শেখান যাতে তারা ইঁদুরের গর্তে বসে না পড়ে বা প্রস্রাব না করে।
সাপ থেকে বাঁচার জন্য টোটকা নয়, দরকার বিজ্ঞানের সহায়তা। ভয় নয়, সচেতনতা ও দ্রুত চিকিৎসা নেওয়াই পারে প্রাণ বাঁচাতে।
আপনি, আমি কিংবা গ্রামের বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তান—সবার জানা উচিত এই বাস্তব ও জরুরি বিষয়গুলো।
সতর্ক থাকুন, সচেতন হোন—অবহেলা নয়, সঠিক জ্ঞানই সাপে কাটার মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে পারে।
স্মরণে রাখুন—সাপ মারবেন না, সাপ বাঁচলে প্রকৃতি বাঁচবে।