প্রকাশ: ২৭শে জুন’ ২০২৫ । আজকের খবর ডেস্ক । আজকের খবর অনলাইন
দীর্ঘ দুই বছর পর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) কাছ থেকে পাওয়া ঋণ সহায়তা এবং সাম্প্রতিক আর্থিক স্থিতিশীলতা রিজার্ভ বৃদ্ধির এই ইতিবাচক ধারা গঠনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।
২০২৩ সালের জুনে সর্বশেষ রিজার্ভ ৩০ বিলিয়নের ঘর অতিক্রম করেছিল। এরপর নানা অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার কারণে তা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। তবে নতুন সরকার গঠনের পর আর্থিক নীতিতে স্বচ্ছতা, রেমিট্যান্সে উৎসাহ ও রফতানি আয় বৃদ্ধির কার্যকর উদ্যোগের ফলাফল ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বৃহস্পতিবার রাতে এক বিবৃতিতে জানান, সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক ঋণ সহায়তা হিসেবে আইএমএফ থেকে দুই কিস্তিতে ১৩৪ কোটি ডলার, এডিবি থেকে ৯০ কোটি ডলার এবং জাইকা থেকে আসা অর্থ রিজার্ভে যুক্ত হওয়ায় মোট পরিমাণ ৩০ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
যদিও আইএমএফের হিসাবপ্রণালী ‘ব্যালান্স অব পেমেন্টস ম্যানুয়াল সিক্স (BPM6)’ অনুসারে হিসাব করলে এই পরিমাণ কিছুটা কমে ২৫ বিলিয়নেরও কিছু ওপরে অবস্থান করছে। তবে এটিও সাম্প্রতিক মাসগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
রিজার্ভ পরিমাপের ক্ষেত্রে ‘নিট রিজার্ভ’ এবং ‘ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ’-এর মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। ব্যয়যোগ্য রিজার্ভের হিসাব সাধারণত প্রকাশ করা না হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সূত্র মতে, বর্তমানে তা প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। যা দিয়ে প্রায় সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় নির্বিঘ্নে পরিচালনা করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক অর্থনীতি অনুসারে, তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভকে একটি নিরাপদ মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
প্রবাসী আয়ের ধারাবাহিক বৃদ্ধি রিজার্ভ বৃদ্ধিতে বড় প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশ থেকে অবৈধ অর্থপাচার কমে যাওয়ার পাশাপাশি হুন্ডির বদলে বৈধ পথে প্রবাসী আয় পাঠানোর প্রবণতা বেড়েছে। ফলে দেশে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে এবং বাজারে চাপ হ্রাস পেয়েছে।
গত দশ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ রেখেছে, যার ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ কমে যাওয়ার ধারাটিও থেমে গেছে। একই সময়ের মধ্যে বাজেট সহায়তা, রাজস্ব খাত সংস্কার এবং সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে পাঁচ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বৈদেশিক ঋণ সহায়তা এসেছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এই অর্জন শুধু রিজার্ভ বৃদ্ধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জোরদারের প্রতিফলন। ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়নে উঠলেও, করোনোত্তর আমদানির চাপ, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ও আমদানি-রফতানি ভারসাম্যের সংকটে তা দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। এছাড়া ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ন্ত্রিত বৈদেশিক ব্যয়ের জন্য সেই সময় রিজার্ভে সংকট ঘনীভূত হয়।
ফলে ২০২২ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আইএমএফের কাছে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের জন্য আবেদন করে, যা পরবর্তীতে বিভিন্ন শর্তসাপেক্ষে পর্যায়ক্রমে ছাড় করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রয়োজনীয় সংস্কার ও দায়সচেতন বাজেট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কারণে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আস্থা পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছে।
নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় রিজার্ভ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও স্বচ্ছতা ও অগ্রাধিকারভিত্তিক ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি আমদানি নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং প্রবাসী আয়ের প্রবাহ অব্যাহত রাখার পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে।
দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে চাঙা করতে এবং বৈশ্বিক মুদ্রা ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে এই রিজার্ভ একটি শক্তিশালী সুরক্ষা বলয় হিসেবে কাজ করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অর্থনীতিবিদ ও বিনিয়োগকারীরা। তবে তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল না থেকে নিজস্ব অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে জোর দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতের সংকটকালীন সময়েও দেশের অর্থনীতি রিজার্ভের মাধ্যমে আত্মরক্ষা করতে পারে।