প্রকাশ: ২৫শে জুন, ২০২৫ | নিজস্ব সংবাদদাতা | আজকের খবর অনলাইন
ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে সমাজে বিভাজনের প্রবণতা নতুন কিছু নয়। তবে শিশুদের মতো নিষ্পাপ, নির্মল হৃদয়ের মানুষের মধ্যে যদি সেই বিভাজনের বীজ পোঁতা হয়, তবে তা একটি সমাজ, একটি জাতি ও একটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। কলকাতার অন্যতম প্রধান পত্রিকা ‘আনন্দবাজার’ সম্প্রতি একটি বিশেষ অনুসন্ধানধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিডডে মিল বা দুপুরের খাবার বিতরণের প্রক্রিয়ায় ধর্মের ভিত্তিতে নির্মিত এক গভীর সামাজিক বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
এই প্রতিবেদনটির লেখক সাংবাদিক কেদারনাথ ভট্টাচার্য্য অত্যন্ত পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সমাজে চলমান একটি সূক্ষ্ম কিন্তু ভয়ঙ্কর বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করেছেন। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে—স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য আলাদা আলাদা রান্না, আলাদা হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাটি, এমনকি আলাদা বসার স্থান পর্যন্ত নির্ধারিত।
স্কুলের মিডডে মিল কার্যক্রমটি, যা মূলত শিশুদের পুষ্টির ঘাটতি পূরণ, বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ এবং সামগ্রিকভাবে জাতিগত ও শ্রেণিগত বিভেদ দূর করার লক্ষ্যে চালু করা হয়েছিল, আজ তা-ই পরিণত হয়েছে ধর্মীয় বৈষম্যের একটি নতুন চেহারায়।
বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, হিন্দু ছাত্রছাত্রীদের জন্য একজন হিন্দু মহিলা রাঁধুনি খাবার প্রস্তুত করেন, আর মুসলমান শিশুদের জন্য নিযুক্ত আছেন একজন মুসলিম মহিলা রাঁধুনি। এমনকি রান্নার সময় ব্যবহৃত বাসনপত্র থেকে শুরু করে, খাবার পরিবেশন ও খাওয়ার জায়গাও দুই সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক রাখা হয়।
স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক জানান, এই রীতি কোনো নতুন উদ্ভাবন নয়। ২০০৫ সাল থেকে এই ভেদাভেদ চলে আসছে। অর্থাৎ, বামফ্রন্ট সরকারের সময় থেকেই এই রীতি বিদ্যমান এবং পরবর্তী সময়ে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের দীর্ঘ সময়েও এই সাম্প্রদায়িক খাদ্যবিভাজন রোধ করা সম্ভব হয়নি। এই তথ্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এটি প্রমাণ করে, পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক মতাদর্শ যাই হোক না কেন, প্রান্তিক পর্যায়ে ধর্মীয় বিভাজনের এই সংস্কারমূলক প্রথা আজও রয়ে গেছে প্রায় অবিকৃতভাবে।
প্রতিবেদনে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, এই ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে হিন্দু ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের একটি বড় অংশ, যারা চান না তাদের সন্তানের খাদ্য প্রস্তুত বা পরিবেশনের সময় কোনো মুসলিম ব্যক্তি সম্পৃক্ত থাকুক। এটি নিছক সামাজিক পছন্দ নয়—বরং এটি গভীর সাম্প্রদায়িক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। অভিভাবকদের এই আচরণ থেকেই স্পষ্ট হয়, সমাজে একটি শ্রেণি এখনও ধর্মীয় ভেদাভেদ, অপবিত্রতার ধারণা ও একপ্রকার জাতপাতের কুসংস্কারে অন্ধভাবে বিশ্বাস করে চলেছে।
অন্যদিকে, মুসলিম অভিভাবকদের পক্ষ থেকে এমন কোনো অভিযোগ বা আলাদা দাবির কথা শোনা যায়নি। বরং তারা চান, সকল শিশু একসঙ্গে বসে, একই রান্না খেয়ে, বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে বেড়ে উঠুক। এই পরিপ্রেক্ষিতে আরও বেদনাদায়ক হয় বিষয়টি। কারণ, অসহিষ্ণুতা ও বিভাজনের উৎস একতরফাভাবে একটি সম্প্রদায়ের দিক থেকেই আসছে, যার বলি হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা।
সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই ঘটনাটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কারণ শিশুরা বিদ্যালয়ে কেবল পাঠ্যপুস্তক শিক্ষা গ্রহণ করে না, তারা শেখে মানবিকতা, সহানুভূতি, বন্ধুত্ব, সমতা ও সামাজিক সহাবস্থান। কিন্তু যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ধর্মের ভিত্তিতে শিশুদের বসার জায়গা আলাদা করে দেওয়া হয়, তাদের খাবার আলাদা করে রান্না করা হয়, তখন শিক্ষালয়ের মৌলিক উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়।
ধর্মের নামে এই বিভাজন শুধু শিশুদের মানসিক বিকাশে বাঁধা নয়, বরং ভবিষ্যতে তাদের মধ্যেই ঘৃণা, অনাস্থা ও বিদ্বেষের বীজ রোপণ করে। তারা বড় হয়ে যে সমাজ গড়বে, তা আর মানবিক কিংবা সহনশীল হবে না। বরং প্রতিপক্ষের ধর্মকে ভয় ও ঘৃণার চোখে দেখা, সমাজে নতুন করে বিভক্তির রেখা টেনে দেওয়া ও নৈতিক অবক্ষয়ই হবে ভবিষ্যতের বাস্তবতা।
এমন অবস্থা প্রমাণ করে, ধর্মনিরপেক্ষতার যে সংবিধানিক অঙ্গীকার আমরা নিয়ে চলেছি, তার মূলে এখনও কতটা ফাঁক রয়ে গেছে। ভারতবর্ষের সংবিধান, যার অন্যতম স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতা, তার রক্ষা ও চর্চা যদি বিদ্যালয়ের মতো একটি মৌলিক প্রতিষ্ঠানেই নিশ্চিত করা না যায়, তবে রাষ্ট্রীয় নীতিমালাগুলো কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।
এখন প্রশ্ন—এই অন্যায়, এই বৈষম্য, এই পশ্চাৎপদ সাম্প্রদায়িক বোধের বিরুদ্ধে কে দাঁড়াবে? প্রশাসন কি চোখ বন্ধ করে রাখবে? শিক্ষাব্যবস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ কি নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকবেন? সমাজের বিবেকবান নাগরিকরা কি প্রতিবাদ জানাবে না? মিডডে মিলের মত একটি জনকল্যাণমূলক প্রকল্পকে যদি ধর্মের হাতিয়ার বানিয়ে বিভাজন রচনা করা হয়, তবে তার প্রতিক্রিয়া হবে ভয়ানক, গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী।
এই প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচিত অবিলম্বে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা, এবং এই ধরনের ধর্মভিত্তিক মিডডে মিল চালু থাকা বিদ্যালয়গুলোর তালিকা তৈরি করে সেসব প্রথা বন্ধ করা। শিশুদের মধ্যে এই বিভেদ রোধে সরকারি প্রশিক্ষণ, সচেতনতামূলক কর্মসূচি, অভিভাবকদের কাউন্সেলিং ইত্যাদি বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
শিশুদের হাতে যদি আগামী সমাজের দায়িত্ব দিতে হয়, তবে তাদেরকে সাম্প্রদায়িকতা নয়—সহাবস্থান, সমবেদনা এবং মানবতার শিক্ষা দিতে হবে। আর তা শুরু হোক বিদ্যালয়ের মিডডে মিলের পাত থেকেই—একই রাঁধুনির রান্না, একই পাত, একই টেবিল, একসাথে বসে খাওয়া—সেটিই হোক নতুন ভারতের পথচলার প্রতীক।