শিরোনাম :
আকাশ ভেঙে আগুনের ঝরাপাত — ১৮৩৩ সালের সেই অলৌকিক উল্কাবৃষ্টি যেভাবে বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে নাড়া দিয়েছিল “শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে খুঁজে পায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ট্রাইব্যুনালের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ” উত্তরা হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যে ক্ষমতাবান পুলিশ কর্মকর্তা: দেশে থেকে পালিয়ে গেলেন বিদেশে – বিচারহীনতার রহস্য তামিম ইকবাল রাজনীতিতে যাত্রা শুরু নিয়ে যা বললেন নগরভবনে মেয়র ইশরাকের সভা অনুষ্ঠিত, তিনি পেলেন শুভেচ্ছা ও ক্রেস্ট ঈদযাত্রার ১৫ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩৯০ জন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলো ইরান, ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা নয় হজযাত্রী নিয়ে ভারতে উড়োজাহাজের চাকার সমস্যা, বের হলো ধোঁয়া ও আগুনের ফুলকি ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সাথে বৈঠকে মির্জা ফখরুল ট্রাইব্যুনালে হাজিরি দেন সাবেক আইজিপি মামুন

গ্রামীণ ব্যাংক, গ্রামীণ টেলিকম ও কর মওকুফ বিতর্ক: সত্যটা জানুন—অপপ্রচার নয়

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ১ জুন, ২০২৫
  • ৩৩ বার

আজকের খবর অনলাইন | প্রকাশ: ১ জুন ২০২৫ | নিজস্ব সংবাদদাতা |

বাংলাদেশের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে একটি সুপরিকল্পিত বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। তাঁকে এবং তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গ্রামীণ ব্যাংক, গ্রামীণ টেলিকম ও কর মওকুফ ইস্যুকে ঘিরে নানা প্রশ্ন, অপবাদ ও সন্দেহ ছড়ানোর অপচেষ্টা চলছে, যার বড় অংশটিই বাস্তব তথ্য ও ইতিহাস থেকে দূরে। এই লেখার উদ্দেশ্য হলো—এই ভুল ধারণাগুলোর মোকাবেলায় সত্যটা তুলে ধরা, পেশাদার সাংবাদিকতা ও দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে।

প্রথমেই আসা যাক গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা প্রশ্নে। বহু মানুষ আজও ভেবে বসে আছেন, এটি ড. ইউনূসের নিজস্ব মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। অথচ বাস্তবতা হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। ১৯৮৩ সালে সরকার কর্তৃক প্রণীত অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের ৯০ শতাংশ শেয়ার এখন রয়েছে সেইসব দরিদ্র নারীদের হাতে, যারা একসময় এই ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে নিজেদের জীবনের চাকা ঘুরিয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকার মাত্র ১০ শতাংশ শেয়ারের মালিক। এই ব্যাংক কোনো উত্তরাধিকারসূত্রে কারও সন্তানের হাতে যাওয়ার সুযোগ নেই, এমনকি ড. ইউনূসের নিজের সন্তানদের কাছেও নয়। তিনি তা লিখে দিয়েছেন দেশের অসংখ্য সুবিধাবঞ্চিত মানুষের নামে, যারা কখনো সেলাই মেশিন, হাঁস-মুরগির খামার কিংবা একটি ক্ষুদ্র দোকানের মাধ্যমে স্বপ্ন দেখেছিলেন জীবনে একটু দাঁড়াবার।

এই প্রতিষ্ঠানে আজ হাজার হাজার মানুষ কর্মরত। কখনো শোনা যায়নি যে তাদের বেতন বন্ধ হয়েছে, বা তারা বোনাস পাননি। এটি একটি সুশৃঙ্খল, কর্মক্ষম, টেকসই প্রতিষ্ঠান, যা সরাসরি বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। এই ব্যাংকের মাধ্যমে শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ক্ষমতায়নের পথও সুগম হয়েছে, বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের জন্য।

এবার আসা যাক “৬৬৬ কোটি টাকার কর মওকুফ” ইস্যুতে। বাস্তবে এই কর মওকুফ চাওয়া হয়েছে কোনো ব্যক্তিগত ব্যবসার জন্য নয়, বরং “গ্রামীণ কল্যাণ” নামক একটি অলাভজনক সংস্থার জন্য। এই সংস্থাটি দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। যদি কর মওকুফ হয়, তাহলে সেই অর্থ ব্যবহার হবে দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কল্যাণে—স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজে। এই টাকা ড. ইউনূসের পকেটে যাবে না, বরং তা যাবে সেই দরিদ্র মানুষের ঘরে—যাদের জন্যই পুরো কর্মজীবন উৎসর্গ করেছেন এই মানুষটি।

এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে—বাংলাদেশে বহু প্রভাবশালী শিল্পপতি রয়েছেন যারা হাজার হাজার কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন, কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো জোরালো পদক্ষেপ বা জনস্বার্থে তেমন কোনো উচ্চকণ্ঠ শোনা যায় না। অথচ যিনি নিজেকে এই দেশের দরিদ্র মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছেন, যিনি বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে পরিচিত করেছেন ‘গ্রামীণ মডেল’ ও সামাজিক ব্যবসার উদ্ভাবক হিসেবে, আজ তাকেই অভিযুক্ত করা হচ্ছে?

ড. ইউনূস যদি সত্যিই কোনো অর্থ পাচার করতেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণসহ বহু আগে আইনানুগ ব্যবস্থা হতো। তাঁর বিরুদ্ধে বিগত দশকে রাষ্ট্রীয় তদন্ত ও অনুসন্ধান হয়েছে, কিন্তু একটি টাকারও অবৈধ লেনদেন প্রমাণ করা যায়নি। দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব পর্যন্ত প্রকাশ্যে বলেছেন—যদি এক টাকার দুর্নীতিও প্রমাণ হতো, তাহলে তাঁকে ‘মাটির সঙ্গে মিশিয়ে’ দেওয়া হতো। বাস্তবতা হলো, কোনো প্রমাণ আজও উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি।

এখন বলা হচ্ছে, তিনি বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন—এই নিয়েও অনেকে সন্দেহ ছড়াচ্ছেন। অথচ আমাদের জানা উচিত, ড. ইউনূসের মতো একজন ব্যক্তি যদি এই কাজে এগিয়ে আসেন, তাহলে এটি সিস্টেমেটিক, স্বচ্ছ এবং শ্রমিকবান্ধব হবে। প্রবাসী কর্মসংস্থানের এই উদ্যোগ সাধারণত প্রতারণা, দালালি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে জিম্মি থাকে। সেখানে তিনি একটি ন্যায্য, মানবিক ও কম খরচের পথ দেখাতে পারেন।

এছাড়া তিনি একটি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার জন্য সরকারের অনুমতি নিয়েছেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি হলো—এই বিশ্ববিদ্যালয়টি হবে এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা কম খরচে উন্নতমানের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাবে। প্রশ্ন হলো, যেখানে বহু বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে ইউনূস স্যার কেন পারবেন না? কেন তাঁর উদ্যোগকে রাজনৈতিকভাবে বাধাগ্রস্ত করা হবে?

আজ যখন ড. ইউনূস দেশের জন্য কাজ করতে চান, তখন আমাদের প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো কতটা তাঁকে সহযোগিতা করছে? বাস্তবতা হলো, কেউ তাঁকে সাহায্য করছে না—এমনকি তাঁকে নিজের কাজগুলোও করতে হচ্ছে একা লড়াই করে। অথচ তাঁর একটি প্রকল্প, একটি পরিকল্পনা বদলে দিতে পারে হাজার হাজার পরিবারের ভবিষ্যৎ। শুধু ক্ষুদ্রঋণ বা বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন, সামাজিক ব্যবসা, রেমিট্যান্স ব্যবস্থাপনা—এমন বহু খাতেই তাঁর মডেল আজও অনুসরণযোগ্য।

সবশেষে একটি প্রশ্ন সবার কাছে—আমরা কি পারি, আমাদের নামে থাকা ব্যাংক, কোম্পানি বা ব্যবসার মালিকানা লিখে দিতে দেশের দরিদ্র মানুষের নামে? যদি না পারি, তাহলে যিনি তা করেছেন, তাঁকে অন্তত অপমান না করি। রাজনীতি নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে, কিন্তু নৈতিকতা নিয়ে নয়।

ড. ইউনূস একটি প্রশ্ন তুলেছেন—এই দেশে যুদ্ধের জন্য মন্ত্রণালয় আছে, কিন্তু শান্তির জন্য নেই। তাঁর ভাবনা, তাঁর অবদান, তাঁর চেষ্টাগুলো যদি আমরা রাজনৈতিক কূটচাল বা ঈর্ষার চোখে না দেখে একটি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তবে হয়তো এই জাতির ভাগ্যেও শান্তি, অগ্রগতি ও সম্মানের এক নতুন অধ্যায় রচিত হতে পারে।

এবং সবচেয়ে বড় সত্যটা হলো—সত্য অনেক সময় অপ্রিয় হলেও, তার পাশে দাঁড়ানোর নামই সাহস।

নিউজটি শেয়ার করুন..

এ জাতীয় আরো খবর..

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২৫