শিরোনাম :
শেখ হাসিনার বিচার শুরু হয়েছে, দলীয়ভাবেও আওয়ামী লীগের বিচার হওয়া উচিত: মির্জা ফখরুল উত্তরের অচেনা বিস্ফোরণ: লেবাননে ইসরাইলি ড্রোন হামলায় নিহত ৩, আহত ১৩ কারামুক্তির পর পর্দায় ফেরার বার্তা: ‘জ্বীন-৩’ দিয়ে ফিরলেন নুসরাত ফারিয়া জামায়াতের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ চীন সফরে জাতীয় সমাবেশে জামায়াতের বার্তা: ৭ দফা দাবিতে বড় গণসমাবেশের প্রস্তুতি বাস রুট পারমিট নিয়ে ঢাকার পরিবহন খাতে অস্থিরতা, সিদ্ধান্তহীনতায় আরটিসি বরিশালে টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা, অচল জনজীবন নিঃসঙ্গ জীবনের করুণ পরিণতি: পাকিস্তানে অভিনেত্রী হুমাইরা আসগরের পচনধরা লাশ উদ্ধার ব্যাটিং বিপর্যয়ে সিরিজ হাতছাড়া, হতাশ মিরাজ জানালেন ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা পুনরায় মহাসংঘর্ষ: রিয়াল-পিএসজির দ্বৈরথে আজ ইতিহাস লিখবে কে?

পাউন্ডের বিপরীতে টাকার রেকর্ড দরপতন: বৈশ্বিক মুদ্রা বাজারে টালমাটাল বাংলাদেশি অর্থনীতি, সামনে কি আরও সংকট?

আজকের খবর ডেস্ক
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন, ২০২৫
  • ১৯৮ বার

প্রকাশ: ২৭শে জুন, ২০২৫ | আজকের খবর ডেস্ক | আজকের খবর অনলাইন

বিশ্ব অর্থনীতির এক জটিল মোড়ের মধ্য দিয়ে চলমান পরিস্থিতিতে, মুদ্রা বিনিময় হারে প্রতিদিনই আসছে নতুন চমক। এরই ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিং-এর বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার মান ২৬শে জুন ২০২৫ তারিখে সর্বনিম্ন রেকর্ড ছুঁয়েছে। একদিনেই পাউন্ডের দাম ছুঁয়েছে ১৬৮.২০ টাকা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবার। যদিও ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জভেদে এই হার কিছুটা কম-বেশি হতে পারে, তবে গড় মূল্য এই রেকর্ড উচ্চতাকেই নির্দেশ করছে।

এ ঘটনাটি নিছক একটি সংখ্যাগত ওঠানামা নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে বহুস্তর বিশ্লেষণ ও গভীর অর্থনৈতিক তাৎপর্য। এই পরিবর্তনের পটভূমি তৈরি হয়েছে মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে পাউন্ডের প্রবল উত্থানের কারণে। যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুদের হার সংক্রান্ত সময়োচিত সিদ্ধান্ত এবং বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার মতো একাধিক ইতিবাচক পদক্ষেপ ব্রিটিশ মুদ্রাকে ২০২১ সালের অক্টোবরের পর থেকে প্রথমবারের মতো ১.৩৭ ডলার অতিক্রম করতে সহায়তা করেছে।

বিশ্ব অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই প্রবল উত্থানের জন্য বড় ভূমিকা রেখেছে ব্রিটেনের মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস, কর্মসংস্থান বাজারে গতি, এবং চীনের সঙ্গে বাণিজ্য পুনর্বিন্যাস। অন্যদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু কৌশলগত বাণিজ্য ছাড়পত্রের মাধ্যমে ব্রিটেন যেসব সুবিধা পুনরুদ্ধার করেছে, সেগুলোর প্রভাবও পড়েছে বিনিময় হারে।

বাংলাদেশে এই বৈশ্বিক উত্থান রূপ নিয়েছে এক ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কায়। দীর্ঘদিন ধরেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান পতনের ধারা দেখা গেলেও, এবার সেই চাপে যুক্ত হয়েছে পাউন্ডেরও ঝাঁপ। এই অবমূল্যায়ন সরাসরি প্রভাব ফেলেছে আমদানি খাতে, প্রবাসী রেমিট্যান্স ব্যবস্থাপনা, উচ্চশিক্ষা ব্যয়, চিকিৎসা খরচ এবং বৈদেশিক ভ্রমণ খাতে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই যদি দ্রুত ও সুসমন্বিত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে এ অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে যাওয়া হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জন্য টিউশন ফি ও আবাসন ভাড়া পরিশোধ এখন প্রায় অসম্ভব পর্যায়ে পৌঁছেছে। আগে যেখানে ১ লাখ পাউন্ডের সমপরিমাণ টাকা লাগত ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার আশপাশে, এখন সেই খরচ গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ১ কোটি ৬৮ লাখের বেশি।

এছাড়া দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি যেসব গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম যুক্তরাজ্য থেকে আমদানি করে, তাদের খরচ এখন প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। এই ব্যয় বৃদ্ধি সরাসরি জনগণের চিকিৎসা ব্যয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।

এদিকে, পাবলিক মানি মার্কেট–এর এক গোপনীয় প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই মুহূর্তে দেশে পাউন্ডে লেনদেনকারী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো তীব্র বৈদেশিক মুদ্রা সংকটে পড়েছে। ব্যাংকগুলো ইতোমধ্যে পাউন্ডের লেনদেনে সীমা নির্ধারণ করছে, নতুন এলসি খোলায় সময় নিচ্ছে এবং কোথাও কোথাও এলসি বন্ধও করে দিয়েছে।

এই সংকটময় মুহূর্তেও বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। এমনকি কোনও সতর্কতা বা পূর্বাভাসমূলক ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়নি সরকারের তরফ থেকে। অর্থনীতিবিদ ও মুদ্রা বিশ্লেষকেরা এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীরবতা পরিস্থিতিকে আরও ঘনীভূত করছে।

অধ্যাপক ড. মাহফুজুল করিম, যিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (BIDS)-এর সাবেক সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বলেন, “এটি শুধু একটি আর্থিক সংকেত নয়, এটি আগামী ছয় মাসের সামষ্টিক অর্থনীতির পূর্বাভাস। যদি এখনই আমদানি নিয়ন্ত্রণ, সরকারি খরচ হ্রাস এবং রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা আনা না যায়, তাহলে ডলার-পাউন্ড উভয় মুদ্রার বিপরীতে টাকার পতন থামবে না।”

বিশ্লেষকরা আরও বলেন, বাংলাদেশকে এখন প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক একটি মুদ্রানীতি সংস্কার, যেখানে রপ্তানি আয়ের গতি বাড়ানো, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে রিজার্ভে ভারসাম্য আনা, এবং বৈদেশিক ভ্রমণ ও বিলাসব্যয় কমানোর ওপর জোর দিতে হবে।

পাউন্ডের রেকর্ড উত্থান ও টাকার রেকর্ড পতনের এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের পরিবারগুলো। যেসব পরিবারে সন্তানরা বিদেশে পড়ছে, বা কেউ চিকিৎসার জন্য ব্রিটেনে রয়েছে, তাদের পক্ষে নতুন বিনিময় হারে অর্থ পাঠানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

অনলাইন ব্যবসা, আমদানি-রপ্তানি, ফ্রিল্যান্সিং—সব খাতেই বিদেশি মুদ্রার ওপর নির্ভরতা থাকায়, সামান্য একটি মুদ্রার উত্থান পুরো অর্থনীতির বুনিয়াদে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে।

অন্যদিকে, অনেকে ভাবছেন পাউন্ডের দাম বাড়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে। তবে এটি আংশিক সত্য হলেও দীর্ঘমেয়াদে দেশের ব্যয়ের তুলনায় উপার্জনের ভারসাম্য যদি ঠিক না থাকে, তাহলে তাতে স্থায়ী সমাধান আসবে না।

পাউন্ডের বিপরীতে টাকার এই রেকর্ড পতন শুধুই আর্থিক সংখ্যা নয়, এটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির একটি শক্ত বার্তা। বিশ্বায়নের এই যুগে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য মুদ্রাবাজারে টিকে থাকা শুধু অভ্যন্তরীণ নীতির ওপর নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করাও জরুরি।

এখনই যদি নীতি নির্ধারকরা বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক ঋণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ—সবখানেই ধস নামতে পারে। পাউন্ডের এই উত্থান আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, টাকার অবমূল্যায়ন আর শুধু ডলারের বিপরীতেই সীমাবদ্ধ নেই—এটি এখন বৈশ্বিক এক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।

নিউজটি শেয়ার করুন..

এ জাতীয় আরো খবর..

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২৫