প্রকাশ: ১৫ই জুন, ২০২৫ | আজকের খবর ডেস্ক
১৯৪৪ সালের মার্চ মাস। দক্ষিণ ক্যারোলাইনার আলকোলু নামের একটি ছোট্ট শহর। সেখানে ১১ বছর বয়সী বেট্টি জুন বিনিক ও তার ৭ বছর বয়সী বোন মেরি এমা বিনিক একদিন সাইকেল চালিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। ফুল তুলতে যাওয়ার পথে তারা একটি কৃষ্ণাঙ্গ কিশোর জর্জ স্টিন্নি জুনিয়রের সঙ্গে কথা বলেছিল। পরদিন, ২৪শে মার্চ, তাদের মৃতদেহ উদ্ধার হয় জর্জের বাড়ির কাছে একটি খালে। হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে তাদের মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়েছিল।
এই হত্যাকাণ্ডের একমাত্র সাক্ষী ছিল জর্জ স্টিন্নি। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করল। কারণ? শুধু সেই দিন মেয়ে দুটিকে কথা বলতে দেখা গিয়েছিল তার সঙ্গে। কোনো ফরেনসিক প্রমাণ, রক্তের দাগ বা স্বীকারোক্তি ছিল না। তবুও, শ্বেতাঙ্গ সমাজের রোষের মুখে পড়ল ১৪ বছরের এই কৃষ্ণাঙ্গ কিশোর।
জর্জকে ৮১ দিন পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়। এর মধ্যে ৮০ দিনই সে একা। তার মা-বাবাকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। কারণ, তখনকার আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গদের রাগ ছিল প্রাতিষ্ঠানিক। জর্জের পরিবারকে সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়। কোনো আইনজীবি তাদের পক্ষে দাঁড়ায়নি।
১৪ই জুন, ১৯৪৪। বিচার শুরু হয়। মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে সবকিছু শেষ। জুরি বোর্ডে ছিলেন শুধু শ্বেতাঙ্গরা। জর্জের পক্ষে কেউ ছিল না। আদালতে সে শুধু একটি বাইবেল ধরে কাঁদছিল, বারবার বলছিল—”আমি নির্দোষ।” কিন্তু কেউ শোনেনি। তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ইলেকট্রিক চেয়ারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
জর্জের পরিবার ও কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার সংগঠনগুলি গভর্নরের কাছে ক্ষমা চাইল। কিন্তু গভর্নর জনস্টন বললেন, “এই শিশুটি বড় মেয়েটিকে ধর্ষণ করতে চেয়েছিল, ছোটটিকে হত্যা করেছিল। পরে মৃতদেহের সঙ্গে সঙ্গম করেছে। এমন পিশাচের কোনো ক্ষমা নেই।” এই বক্তব্যের কোনো প্রমাণ ছিল না। শুধু ঘৃণা ও বর্ণবিদ্বেষের অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল সত্য।
১৬ই জুন, ১৯৪৪। সন্ধ্যা ৭টা ২৫ মিনিট। জর্জকে তার বাবার সঙ্গে শেষ দেখা করতে দেওয়া হয়। তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ইলেকট্রিক চেয়ারের কাছে। মাত্র ৫ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা এই কিশোরের হাত-পা বাঁধা হয়। মাথায় দেওয়া হয় ইলেকট্রিক হেলমেট। সে কাঁদছিল, চিৎকার করে বলছিল—”আমি নির্দোষ!” কিন্তু কেউ থামেনি। ৭টা ৩০ মিনিটে ৫,৩৪০ ভোল্টের বিদ্যুৎ দেয়া হয় তার দেহে। ৮ মিনিট পর জর্জ মারা যায়। তার দাঁত পুড়ে গিয়েছিল, চোখের কোথাও চিহ্ন ছিল না।
২০০৪ সাল। নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির একদল আইনজীবী এই মামলাটি পুনরায় খোলেন। ১০ বছর গবেষণার পর ২০১৪ সালে আদালত রায় দেন—জর্জ স্টিন্নি নির্দোষ। তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণই সত্য নয়। ধর্ষণের অভিযোগও মিথ্যা ছিল।
জর্জ স্টিন্নির মৃত্যুর ৭০ বছর পর ন্যায়বিচার এলেও তাকে ফিরিয়ে আনা যায়নি। এই নির্মম ইতিহাস আমাদের শেখায়—বিচারবিভাগীয় ব্যবস্থা যদি পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তাহলে তা কতটা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। আজও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বর্ণ, জাতি, ধর্মের নামে এমন অসংখ্য জর্জ স্টিন্নি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তাদের কথা ভেবে দেখার সময় এসেছে।