প্রকাশ: ১১ জুন ২০২৫ | আজকের খবর ডেস্ক | আজকের খবর অনলাইন
বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিনের দুর্নীতির অভিযোগ আবারও নতুন করে সামনে এসেছে। এবারে অভিযোগের কেন্দ্রে রয়েছে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী লোভা নদীর জব্দকৃত বিপুল পরিমাণ পাথরের নিলাম কার্যক্রম। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে বিশেষ সুবিধা দিতে প্রায় ১০০ কোটি টাকার পাথর মাত্র ১৭ কোটি টাকায় নিলামে তুলে দেওয়া হয়েছে। এতে সরকারের রাজস্বের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, জব্দকৃত এক কোটি পাঁচ হাজার ঘনফুট পাথরের মধ্যে ৪৪ লাখ ঘনফুট পাথরকে ‘মামলার আওতাবহির্ভূত’ দাবি করে তা নিলামের আওতায় আনা হয়। নিলামের ভিত্তিমূল্য ধরা হয় প্রতি ঘনফুট ৭৫ টাকা, যা বর্তমান বাজারমূল্যের তুলনায় অনেক কম। বর্তমানে ঘনফুট প্রতি পাথরের বাজারমূল্য ১২৫ টাকা। অর্থাৎ, এক কোটি ঘনফুট পাথরের প্রকৃত মূল্য যেখানে ১২৫ কোটি টাকারও বেশি, সেখানে তা পানির দরে মাত্র ১৭ কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে। এতে শুধু সরকারই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, বরং জনস্বার্থেরও মারাত্মক হানি ঘটেছে।
এই নিলাম প্রক্রিয়ায় সরকারি দপ্তর খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি)-এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে, বিএমডির পরিচালক ও যুগ্ম সচিব ছরোয়ার হোসেন নিলাম কার্যক্রমে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি স্থানীয়দের দাবিতে উঠে এসেছে, নিলাম কার্যাদেশ বাস্তবায়নের সময় তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার আয়োজিত ভোজেও অংশগ্রহণ করেন। বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার প্রশ্ন তোলে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পাঁচ বছর আগে স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাক আহমদ পলাশ অবৈধভাবে বিশাল পরিমাণ পাথর মজুত করেন। ২০১৯ সালে এই পাথর জব্দ হলেও তা গোপন রাখা হয়। সামী এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান নিলামের স্বচ্ছতা নিয়ে হাইকোর্টে আবেদন করলে আদালত তৎকালীন নিলাম কার্যক্রম স্থগিত করেন। কিন্তু কৌশলে ‘রিট বহির্ভূত’ ট্যাগ লাগিয়ে ৪৪ লাখ ঘনফুট পাথর আবার নিলামে দেওয়া হয়, যা আদালতের আদেশের সরাসরি লঙ্ঘন।
স্থানীয় পাথর ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ২০১৯ সালে পাথরের দাম ছিল ঘনফুট প্রতি ৯০ টাকা। সময়ের সঙ্গে বাজারদর বেড়ে বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ১২৫ টাকায়। অথচ পাঁচ বছর আগের দরে নিলাম সম্পন্ন করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিজেদের সুবিধার পথ তৈরি করেছেন। বাজারদরের তুলনায় ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে সরকার ও জনগণের।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, দেশের গেজেটভুক্ত পাথর কোয়ারিগুলোর সর্বশেষ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয় গত ৪ মে, যেখানে সভাপতিত্ব করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। সভায় জানানো হয়, মামলাবহির্ভূত বলে দাবি করা ৪৪ লাখ ঘনফুট পাথর ২১ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়েছে এবং তা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, প্রকৃত নথিপত্রে বিক্রয়মূল্য কম দেখিয়ে সরকারি রাজস্ব থেকে বিশাল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।
বিএমডির মহাপরিচালক মো. আনোয়ার হাবীব বলেছেন, “লাভাছড়ার পাথর নিলামের বিষয়ে আমার জানা আছে। তবে কী পরিমাণ পাথর বা কত দামে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে, তা না দেখে এখনই বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়।” এ মন্তব্য দায়িত্বহীন এবং প্রশ্নবিদ্ধ, বিশেষত যখন সরকারের রাজস্বের শত কোটি টাকার ক্ষতির অভিযোগ ওঠে।
এ বিষয়ে একাধিকবার ফোন করে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও পরিচালক ছরোয়ার হোসেন সাড়া দেননি। প্রথমবার তিনি বলেন, “এক ঘণ্টা পর কথা বলবেন।” কিন্তু পরবর্তীতে তিনি কল রিসিভ না করেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। তার এই অবস্থান গোটা প্রক্রিয়া সম্পর্কে সন্দেহকে আরও জোরালো করে তোলে।
অভিযোগ রয়েছে, পুরো নিলাম কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে একটি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে, যাতে অন্য কোনো পক্ষ অংশগ্রহণ করতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, নিলাম কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজয়ী প্রতিষ্ঠান দ্রুততার সঙ্গে পাথর অপসারণের কাজ শুরু করে, যা পূর্বপরিকল্পিত পরিকল্পনারই ইঙ্গিত দেয়।
সরকারি সম্পদ লুটপাটের এই অভিযোগ শুধু প্রশাসনের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে না, বরং রাজনৈতিক দলের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত করে। দেশে পাথর ও অন্যান্য খনিজ সম্পদের উপর জনগণের যে আস্থা ছিল, এই ধরনের ঘটনাগুলো তাতে মারাত্মক আঘাত হানে। তদন্ত না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হবে।
সংশ্লিষ্ট মহল, সুশীল সমাজ ও স্বচ্ছতা সংস্থাগুলো জোর দাবি জানিয়েছে, এই ঘটনার একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্বাধীন তদন্ত হওয়া জরুরি। যারা সরকারকে রাজস্ব বঞ্চিত করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছে, তাদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে প্রশাসনের মধ্যে থেকে যারা এই প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে এক প্রশ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—বাংলাদেশ কি পাথরের চেয়েও কঠিন দুর্নীতির দেয়াল ভাঙতে প্রস্তুত? তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে জনগণ সবকিছু জানে এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি অনিয়ম এখন খুব সহজেই জনগণের আদালতে পৌঁছায়। তাই প্রশাসনের উচিত হবে, অবিলম্বে দায়ীদের বিচারের আওতায় এনে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করা।
তথ্যসূত্র: যুগান্তর, মাঠ পর্যায়ের সাক্ষাৎকার, খনিজ উন্নয়ন ব্যুরোর নথিপত্র পর্যালোচনা।