আজকের খবর অনলাইন | প্রকাশ: ২ জুন ২০২৫ | নিজস্ব সংবাদদাতা
ভালোবাসা শব্দটি যেমন হৃদয়গ্রাহী, তেমনি তার ভেতর লুকিয়ে থাকে ভয়াবহ এক বাস্তবতা—যখন সেই ভালোবাসার নামে জন্ম নেয় প্রতারণা, বিশ্বাসভঙ্গ, পরিবার ভাঙন এবং সামাজিক অবক্ষয়। পরকীয়া, যা আধুনিক সমাজে প্রায়শই এক আবেগনির্ভর ‘ব্যক্তিগত বিষয়’ হিসেবে উপস্থাপিত হয়, বাস্তবিক অর্থে তা কেবল একটি সম্পর্ক নয়—তা হয়ে দাঁড়ায় একটি পরিবার ধ্বংসের সূচনা, একজন নারীর আত্মপরিচয় লোপের যন্ত্রণা, আর সমাজের নৈতিক ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার এক নিঃশব্দ ট্র্যাজেডি।
একজন বিবাহিত পুরুষ যখন নিজের স্ত্রী ও সন্তান রেখে অন্য নারীর জীবনে প্রবেশ করেন ‘ভালোবাসা’র নামে, তখন তা যতটা আবেগময় বলে মনে হয়, বাস্তবে তা হয় আত্মস্বার্থ, ভোগ এবং দায়িত্বহীনতার কুৎসিত রূপ। পুরুষটি হয়তো বলে—”তুমি ছাড়া আমি বাঁচতে পারি না”, কিংবা “আমার স্ত্রী আমাকে বোঝে না, আমি একা”—এইসব করুণ আবেদনের আড়ালে যে নির্মম প্রতারণা লুকিয়ে থাকে, তা প্রথম দিকে স্পষ্ট হয় না। নারীটি ভাবেন, হয়তো তিনিই সেই আশ্রয়, যার কাঁধে ভর করে এক বিধ্বস্ত পুরুষ তার জীবনে নতুন শুরু করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, সেই পুরুষটি কখনোই তার গৃহস্থ জীবন, সামাজিক পরিচয় বা সন্তানদের ছেড়ে নারীর হাতে নিজের ভবিষ্যৎ তুলে দেয় না।
পরিণামে একজন নারী ধীরে ধীরে এক অদৃশ্য আবেগের খাঁচায় আবদ্ধ হয়ে যান। দিনের পর দিন কেবল প্রতিশ্রুতি শোনেন, অথচ বাস্তবতা শূন্য। যে মানুষটি তাঁকে একসময় বলেছিল “তুমি আমার সব”, সে-ই মানুষটি আজও রাত শেষে ফিরে যায় তার নিজের বৈধ ঘরে, স্ত্রী ও সন্তানের কাছে, সামাজিক নিরাপত্তার ভিতর। নারীটি রয়ে যান এক প্রান্তিক, অস্বীকৃত, অদৃশ্য সম্পর্কের মধ্যে—যা তাঁকে কেবলই ক্লান্ত, একা, অপমানিত আর দিশাহীন করে তোলে।
এইসব সম্পর্কের চূড়ান্ত ফলাফল হয় হৃদয়বিদারক। স্বামী পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়লে এক নারী সংসার সামলাতে গিয়ে আত্মসম্মান হারান। স্ত্রী যখন জানতে পারেন স্বামী তাকে প্রতারণা করছে, তখন শুধুই সংসার নয়, তার আত্মবিশ্বাসও ভেঙে পড়ে। বহু স্ত্রী এই মানসিক আঘাত সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নিয়েছেন। অনেকে নীরব থাকে সন্তানের মুখ চেয়ে, আবার কেউবা বিচ্ছেদে যান, অথচ ভেতরে লালন করেন অপমান ও বেদনার পাহাড়।
সবচেয়ে করুণ বাস্তবতা দেখা যায় সন্তানদের মধ্যে। বাবা-মায়ের দ্বন্দ্ব, পরকীয়ার কারণে ধীরে ধীরে ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক—এই সবকিছু শিশুর কোমল মনের উপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। স্কুলে তারা উপহাসের শিকার হয়, পরিবারে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, আর বড় হয়ে ওঠে এক ধরনের বিষাক্ত মানসিক কাঠামোর ভিতর দিয়ে। বহু সন্তান বাবা-মায়ের এইসব পরকীয়াজনিত ঝগড়ার কারণে হতাশায় ডুবে যায়, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, এমনকি মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
পরকীয়া কেবল প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক নয়, এর আরেক প্রান্তে পড়ে থাকা একজন নারীকে প্রতিনিয়ত পোড়ায় আত্মদহনে। তিনি ভাবেন, সেই পুরুষটি হয়তো একদিন তাঁকে সমাজের সামনে স্বীকৃতি দেবে, নতুন জীবন শুরু করবে, কিন্তু সময় যত গড়ায়, সে পুরুষ আরও নিপুণভাবে নিজের সংসার রক্ষা করতে শেখে। সেই নারী একদিন উপলব্ধি করেন, তিনি কেবল একজন ক্লান্ত পুরুষের বিনোদন বা প্রশান্তির বাহন ছিলেন, ভালোবাসার মানুষ নন।
পরকীয়ার অনেক ‘আধুনিক’ যুক্তি উঠে আসে, বলা হয়—ভালোবাসা তো আবেগের বিষয়, আইন দিয়ে ভালোবাসা বেঁধে রাখা যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই আবেগ যদি একজন স্ত্রীকে কান্নায় ভাসিয়ে দেয়, একজন সন্তানের শৈশব চুরি করে নেয়, একজন নারীর আত্মপরিচয় মুছে দেয়—তাহলে সেই আবেগ আর ব্যক্তিগত থাকে না, তা হয়ে ওঠে সামাজিক অপরাধ। সেই আবেগ ভালোবাসা নয়, তা আত্মকেন্দ্রিক লালসা।
আজ পর্যন্ত কতজন পুরুষ এমন সম্পর্ক থেকে নিজেদের সব কিছু বিসর্জন দিয়ে সেই নারীকে গ্রহণ করেছেন? সংখ্যাটা এতই নগণ্য যে তারা ব্যতিক্রম হিসেবেই ইতিহাসে জায়গা পায়, বাস্তব জীবনে না। সমাজে, পারিবারিক পরিসরে, কর্মক্ষেত্রে, এমনকি বন্ধু মহলেও দেখা গেছে—পরকীয়ায় জড়ানো পুরুষটির জীবন কখনোই তার বর্তমান সম্পর্ককে ‘প্রথম পছন্দ’ বানায় না। বরং সে চালিয়ে যায় দ্বৈত সম্পর্ক, একটিকে রাখে ‘আনুষ্ঠানিক’, আর অন্যটিকে ‘আবেগনির্ভর গোপনতা’ হিসেবে।
এই পরিস্থিতির একমাত্র প্রতিকার—সচেতনতা, আত্মমর্যাদা ও কঠিন সিদ্ধান্ত। একজন নারীকে ভাবতে হবে, সে একজন পুরুষের জীবনের একটি গোপন অধ্যায় হতে চান কিনা, নাকি একজন পূর্ণাঙ্গ, স্বীকৃত সঙ্গী হতে চান। যে পুরুষ দিনের আলোয় তাকে সমাজের সামনে তুলে ধরতে চায় না, তাকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা মানে আত্মপ্রবঞ্চনা।
ভালোবাসা কেবল তখনই অর্থবহ, যখন সেটার ভেতরে থাকে সাহস, সততা, স্বীকৃতি এবং সম্মান। যেকোনো সম্পর্কের কেন্দ্রে থাকা উচিত এই চারটি বিষয়। যা নেই সাহসে, নেই সম্মান আর নেই সামাজিক দায়বদ্ধতায়—তা ভালোবাসা নয়, তা এক নিষ্ঠুর পরকীয়ার মুখোশ, যা শুধু একজন নারী নয়, একটি পরিবার, একটি সমাজকে পুড়িয়ে দেয় নিঃশব্দ আগুনে।
আপনি জন্মাননি কারও গল্পের প্রান্তিক চরিত্র হতে। আপনি একজন মূলনায়িকা—নিজের গল্পে, নিজের জীবনে, নিজের মর্যাদায়। যে আপনাকে আঁকড়ে ধরতে পারে না, যে আপনাকে সবার সামনে proudly বলতে পারে না—“এই নারীই আমার পৃথিবী”—সে আপনার জীবনে থাকার যোগ্য নয়। এখন সময়, নিজেকে ভালোবাসার, নিজের গল্প নিজে লেখার। কারণ একজন নারীর আত্মমর্যাদা, সাহস, বিশ্বাস—এটাই একজন পুরুষের থেকেও বড় ভালোবাসার সংজ্ঞা।