আজকের খবর অনলাইন
প্রকাশ: ১ জুন ২০২৫
নিজস্ব সংবাদদাতা, টোকিও ও ঢাকা
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের বিদেশ সফর সম্পন্ন হলো জাপানে। এই সফর ছিল রাজনৈতিক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং ছিল কৌশলগত লক্ষ্য ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বাস্তবায়নে এক কার্যকর পদক্ষেপ। সফরটি ছিল মাত্র তিন দিনের, কিন্তু সময় ব্যবস্থাপনা, কর্মসূচির গুণগত মান এবং অর্জিত অগ্রগতি—সবদিক থেকেই এটি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ ও নজরকাড়া।
প্রফেসর ইউনূস জাপানে এসেছিলেন বিশ্বখ্যাত নিক্কেই গ্রুপের আমন্ত্রণে এবং সফরকালীন তাঁর যাতায়াত, আবাসন, খাদ্যসহ অন্যান্য খরচ সম্পূর্ণভাবে বহন করেছে আমন্ত্রণকারীরা। সরকারি কোষাগার থেকে এক পয়সাও ব্যয় হয়নি—এটি ছিল এই সফরের অন্যতম অনন্য দিক। এই আন্তরিকতা কেবল কূটনৈতিক সৌজন্য নয়, বরং প্রফেসর ইউনূসের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতারই প্রতিফলন।
সফরের প্রধান অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যকার অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং ভবিষ্যতের কর্মসংস্থান নীতিমালার রূপরেখা। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশকে মোট ১.০৬৩ বিলিয়ন ডলারের অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৪১৮ মিলিয়ন ডলার যাবে অর্থনৈতিক সংস্কার এবং জলবায়ু সহনশীলতা উন্নয়নে, ৬৪১ মিলিয়ন ডলার ব্যবহৃত হবে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রেলপথ উন্নয়নের জন্য এবং ৪.২ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ থাকবে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপ সহায়তায়।
এই বৈঠকে আরও আলোচিত হয় ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (EPA)। ২০২৬ সালের নভেম্বরের পর বাংলাদেশ আর স্বল্পোন্নত দেশের (LDC) সুবিধা পাবে না। ফলে এই চুক্তিটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সেই সুবিধাগুলোর কিছু অংশ বজায় রাখার একটি দরজা খুলে দেয়। বাণিজ্যিক শুল্ক ছাড়, দীর্ঘমেয়াদি সফট লোন এবং বিনিয়োগ সুবিধা অব্যাহত রাখার জন্য EPA ভবিষ্যতের নির্ভরযোগ্য কৌশল হতে যাচ্ছে।
মানবসম্পদ উন্নয়নকে এই সফরে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রফেসর ইউনূস সরাসরি ঘোষণা করেছেন যে বাংলাদেশ থেকে জাপানে অন্তত এক লাখ দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি কেবল বৈদেশিক আয়ের উৎস নয়, বরং প্রতিটি কর্মীর পরিবারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতি নিশ্চিত করবে। একজন শ্রমিক যদি মাসে গড়ে ৫০ হাজার টাকা রেমিট্যান্স পাঠান, তবে মাসিক প্রবাহ দাঁড়ায় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এমন পরিবর্তন শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি জাতীয় উন্নয়নের এক স্তম্ভে পরিণত হতে পারে।
জাপানে বাংলাদেশি কর্মসংস্থানবিষয়ক দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলেও, কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে একচেটিয়া অনুমতি দেওয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে কিছু সংবাদমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশিত হলেও স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে—জাপানে রয়েছে তিন হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশেও রয়েছে শতাধিক রিক্রুটমেন্ট সংস্থা। এই বড় পরিসরের অংশগ্রহণের মাধ্যমে মানবসম্পদ প্রেরণ কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
কর্মসংস্থানের নামে প্রতারণা রোধে একটি মাত্র সরকারি চ্যানেল থেকে তথ্য প্রদান নিশ্চিত করার পরিকল্পনাও রয়েছে, যা প্রবাসী নিরাপত্তার জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে।
জাপানের নিক্কেই ফোরামে প্রফেসর ইউনূস কীনোট বক্তা হিসেবে অংশ নেন, যেখানে উপস্থিত ছিলেন ASEAN দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানরা। বাংলাদেশ এখনো ASEAN-এর সদস্য না হলেও, সদস্যপদের জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ফোরামে তাঁর বক্তৃতা—বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রে “Ministry of War” বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থাকলেও, “Ministry of Peace” নেই—এই বক্তব্য ফোরামের প্রতীকি বানী হয়ে ওঠে। এতে বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ অবস্থান ও কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি উঠে আসে।
এছাড়া ট্রাম্প প্রশাসনের পরিণত নীতিমালা, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের চ্যালেঞ্জ, এবং রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাঁর বক্তব্য প্রশংসা কুড়িয়েছে।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে টোকিওস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে এক সভায় তিনি মতবিনিময় করেন। প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি—নারিতা-ঢাকা সরাসরি বিমান রুট পুনরায় চালু করার আবেদন—উপদেষ্টার নজরে এসেছে। তিনি বিষয়টিকে ‘হোমওয়ার্ক’ হিসেবে চিহ্নিত করে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রবাসীদের এই আবেগঘন দাবির প্রতি সরকার ইতিবাচক মনোভাব নেবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে।
এই সফরের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল, জাপানি কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিনিময়। কিছু প্রতিষ্ঠান এমন উদ্যোগের পরিকল্পনা করেছে যেগুলোর লক্ষ্য শুধুমাত্র মুনাফা নয়, বরং মানুষের জীবনমান উন্নয়ন। যেমন, এক জাপানি উদ্যোক্তা বাংলাদেশে জাপানিজ শেফ তৈরির একটি স্কুল স্থাপন করতে চান—যেখান থেকে তৈরি হওয়া শেফরা সারা বিশ্বে কাজ করতে পারবেন। আবার অন্য এক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে এনিমে নির্মাতা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের আগ্রহ দেখিয়েছে। বিশ্বব্যাপী এনিমে শিল্পের চাহিদা বাড়ছে, বাংলাদেশ হতে পারে সেই ঘাটতির বিকল্প যোগানদাতা।
সবমিলিয়ে এই সংক্ষিপ্ত সফরটি বাংলাদেশের কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবসম্পদ উন্নয়নের সম্ভাবনাকে নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। এই অর্জন সময়োপযোগী বাস্তবায়ন এবং স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি সুফলে পরিণত হলে, তা হবে জাতির জন্য এক অনন্য মাইলফলক। জাপান সফর থেকে ফিরে প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া বার্তা ছিল সংক্ষিপ্ত, কিন্তু গভীরতর: “আমরা শুধু উন্নয়ন চাই না, আমরা চাই একটি সুখী রাষ্ট্র—যেখানে উন্নয়ন হবে মানুষের মুখের হাসিতে।”