প্রকাশ: ২০শে জুন ২০২৫ | নিজস্ব সংবাদদাতা | আজকের খবর অনলাইন
ইরান তাদের রাষ্ট্রীয় ও কৌশলগত কাঠামোতে এক বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলি খামেনি সম্প্রতি তার সমস্ত কার্যকরী ও কৌশলগত ক্ষমতা ‘ইরানিয়ান রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস’ (IRGC) – এর একটি অভ্যন্তরীণ কমিটি, যেটি ‘সুপ্রিম হাউস’ নামে পরিচিত, তার হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেছেন। এই ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত ইরানের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামরিক কাঠামোয় এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়, যা ভবিষ্যতের জন্য বিস্তৃত পরিণতির পথ উন্মুক্ত করছে।
এই সিদ্ধান্তটি শুধু প্রশাসনিক কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়—এটি কার্যত ইরানের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ক্ষমতা একটি সশস্ত্র, আদর্শবাদী ও বিপ্লবনিষ্ঠ গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেয়ার সমান। এখন থেকে সামরিক হামলা, পারমাণবিক কর্মসূচি, কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া কিংবা ভূ-রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ—সব কিছুতেই এই শক্তিশালী গোষ্ঠী হবে মূল নিয়ামক। ধর্মীয় অনুমোদন বা খামেনির ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ ছাড়াই তারা পদক্ষেপ নিতে পারবে।
এই সিদ্ধান্ত এমন একটি সময়ে এসেছে, যখন ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা অভূতপূর্ব উচ্চতায় পৌঁছেছে। ইরানের উপর ইসরায়েলি আগ্রাসন এবং পারস্য উপসাগরে মার্কিন নৌ উপস্থিতি বাড়তে থাকায় মধ্যপ্রাচ্য হয়ে উঠেছে এক বিস্ফোরণোন্মুখ অঞ্চলে। খামেনি এই পদক্ষেপ নিয়ে শুধু সামরিক ও রাষ্ট্রীয় সক্ষমতাকে সংহত করেননি, বরং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতিও নিশ্চিত করেছেন—যদি কোনো কারণে তিনি সরাসরি নেতৃত্ব প্রদানে অক্ষম হন, তাহলে দেশের নেতৃত্ব যেন ছিন্ন না হয়।
এই হস্তান্তরের অর্থ দাঁড়ায়, ইরান এখন সাময়িকভাবে হলেও এক ধরনের ‘আধ্যাত্মিকভাবে অনুমোদিত সামরিক শাসনে’ প্রবেশ করেছে। বিপ্লবী গার্ড এখন কেবল প্রতিরক্ষা বাহিনী নয়—তারা এখন কার্যকরভাবে দেশের প্রশাসনিক ও কৌশলগত চালক। তাদের হাতে রয়েছে সর্বোচ্চ পরমাণু সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, যা আগে শুধুমাত্র খামেনির ধর্মীয় ও নৈতিক কর্তৃত্বাধীন ছিল।
এই পদক্ষেপের পিছনে যে বাস্তবতা তা হলো, ইরানের সর্বোচ্চ নেতার জীবন এখন হুমকির মুখে। স্বাস্থ্যগত অবস্থা কিংবা সম্ভাব্য টার্গেট হিসেবে তার নাম বারবার উঠে আসায় এখন তাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নিরাপত্তাবলয়। এই বাস্তবতা ও চাপ বিবেচনায় রেখে এই ক্ষমতা হস্তান্তর ভবিষ্যতের সংকট মোকাবিলায় একটি প্রস্তুতি হিসেবেই ধরা হচ্ছে।
এই সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন ইরানের ‘সংস্কারপন্থী’ গোষ্ঠীর উপরও এক ধরনের রাশ টেনে ধরার চেষ্টা, যাদের সাথে পশ্চিমা জোটের যোগাযোগ রয়েছে বলে মনে করা হয়, অন্যদিকে তা পশ্চিমা শক্তিগুলোর উদ্দেশে এক স্পষ্ট বার্তাও—তোমরা যদি খামেনিকে টার্গেট করো, তবে আরও কঠোর, অপ্রতিরোধ্য একটি নেতৃত্ব তোমাদের সামনে দাঁড়াবে।
এই পরিবর্তনের ফলে ইরানের নীতি এখন আগের চেয়ে বেশি গতিশীল, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ হবে দ্রুত, এবং তা বাস্তবায়নে আর কোনো দ্বিধা বা ‘ধর্মীয় সমর্থনের’ অপেক্ষা থাকবে না। বিশেষ করে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে এটি ইরানকে একটি শক্ত হাতে শাসিত সামরিক রাষ্ট্রে পরিণত করবে।
এই ঘটনাটি শুধু ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিরই প্রতিফলন নয়, বরং সমগ্র পশ্চিম এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যকে নাড়িয়ে দিতে পারে। এটি মধ্যপ্রাচ্য ও এর বাইরের সব কৌশলগত অংশীদারদের জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা: ইরান শুধু প্রস্তুত নয়, বরং এখন তাদের সর্বোচ্চ সংহত শক্তিকে সামনে নিয়ে এসেছে। এবং এই নতুন শাসন কাঠামো—যেখানে পোশাকে আবায়ার চেয়ে খাকি প্রাধান্য পাচ্ছে—ইঙ্গিত করছে, পরবর্তী পদক্ষেপ হতে যাচ্ছে আরও সুপরিকল্পিত এবং নির্মম।
মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত একটি মৌলিক মোড় পরিবর্তনের সূচনা করেছে—যে পরিবর্তন হয়তো আগামী দশকের জন্য গঠন করে দেবে এই অঞ্চলের নতুন শক্তির ভারসাম্য।