প্রকাশ: ১৮ জুন, ২০২৫ | আজকের খবর ডেস্ক | আজকের খবর অনলাইন
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালকে ঘিরে বাংলাদেশে ভিন্নমতের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল, তা এক গভীর রাজনৈতিক, আইনি ও মানবিক সংকটের প্রতিচ্ছবি বহন করে। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন গঠিত গুম কমিশনের সদ্য প্রকাশিত দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিবেদন এই সংকটের একটি প্রামাণ্য দলিল রূপে আবির্ভূত হয়েছে, যেখানে তথ্য, সাক্ষ্য ও পর্যালোচনার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায় উন্মোচিত হয়েছে।
প্রতিবেদনের এক প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে যে কোনো ধরনের মত প্রকাশ, বিশেষ করে অনলাইনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সরকারি প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রীয় নীতির সমালোচনাকে ‘জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণ নাগরিকদের পোস্ট, ভিডিও বা রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতির প্রকাশকেও উগ্রতা কিংবা সহিংসতার প্ররোচনা হিসেবে দেখা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং বহুল সমালোচিত আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা, যা প্রকৃতপক্ষে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দমনমূলক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
প্রতিবেদনে যেসব মামলা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, সেখানে প্রায় একই ধরনের ভাষা ও অভিযোগের পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কিংবা সরকারের নীতির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ—সবকিছুকেই ‘অস্থিরতা সৃষ্টি’ বা ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্ন’ ঘটানোর চেষ্টার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। মামলার এজাহার ও চার্জশিটে ‘সন্দেহভাজন’দের পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা, গোয়েন্দা তথ্যে অভিযান পরিচালনার দাবি এবং গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে ‘তাৎক্ষণিক স্বীকারোক্তি’র মতো অজুহাতকে বহু মামলায় কপি-পেস্ট আকারে ব্যবহার করা হয়েছে। এই ধরনের কাজগুলো আইনি প্রক্রিয়া ও ন্যায়ের পরিপন্থী, বরং একটি নির্দিষ্ট দমননীতির প্রমাণ বলে গণ্য হয়েছে।
অন্যদিকে প্রতিবেদনে আরও উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে যে, সন্দেহভাজনদের কাছ থেকে পুলিশ কর্তৃক আদায়কৃত স্বীকারোক্তি প্রায় সবক্ষেত্রেই তাৎক্ষণিক ও গোয়েন্দা তথ্যে ভিত্তিক ছিল। এসব স্বীকারোক্তি আদালতের স্বীকৃত প্রমাণ না হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘ সময় আটক রেখে বা মামলাজট তৈরি করে ভুক্তভোগীদের আর্থিক, সামাজিক ও মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত করা হয়েছে। অনেক সময় ধর্মীয় বই বা নথিপত্রকেও ‘জিহাদি সাহিত্য’ হিসেবে উপস্থাপন করা হতো, যা নিছক ধর্মচর্চাকেও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে তুলে ধরার একটি ভয়াবহ প্রবণতা।
প্রতিবেদনে বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা, পক্ষপাত এবং একচোখা ন্যায়বিচারের নানা দিকও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। একই ধরনের মামলায় পূর্বনির্ধারিত কাঠামো ব্যবহার, দীর্ঘ মেয়াদি শুনানি বিলম্বিত করা, ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তারকে বৈধতা দেওয়া, কিংবা আদালতের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের বিষয়টিকে একটি কাঠামোগত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে করে বিচার বিভাগ কার্যত এক ধরনের ‘নির্দেশনাভিত্তিক’ বিচার ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছিল বলেই ধারণা করা হয়।
প্রতিবেদনের আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো, এসব মামলার আর্থিক বোঝা ভুক্তভোগীদের জীবনে কী ধরনের স্থায়ী ক্ষতি করেছে, তা বিশ্লেষণ করা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, একটি মামলার পেছনে একজন ব্যক্তি বা পরিবারকে তাদের বার্ষিক আয়ের দ্বিগুণ ব্যয় করতে হয়েছে। অনেকে জীবনের কয়েক বছরের সঞ্চয় হারিয়েছেন, বাড়িঘর বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন, এমনকি দীর্ঘমেয়াদি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ফলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো আইনি দমননীতির একটি ভয়ংকর বলয়ে আটকা পড়ে গেছেন, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সরাসরি প্রতিফলন।
গুম কমিশনের এই প্রতিবেদন একটি আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্পষ্ট করেছে—গুম ও বলপূর্বক অন্তর্ধান নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক অস্বীকার বা ‘ডিনায়াল কালচার’ তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার বারবার গুমের অস্তিত্ব অস্বীকার করে এসেছে এবং ক্ষমতা পরিবর্তনের পরও এই অস্বীকারনীতি অব্যাহত রয়েছে। ফলে অপরাধীরা ক্ষমতার বলয়ে থেকে প্রমাণ ধ্বংস, সাক্ষীকে হুমকি এবং নির্যাতিতদের মুখ বন্ধ রাখার জন্য ভয়ভীতির পরিবেশ বজায় রেখেছে। কমিশনের সদস্যরাও এই ভয়ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতা থেকে মুক্ত ছিলেন না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
এই পটভূমিতে কমিশন বেশ কিছু সুপারিশও করেছে। বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে স্বাধীনভাবে কার্যকর করার জন্য আপিল বিভাগের স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এতে আইনের শাসন ও মানবাধিকার রক্ষায় এক ধাপ অগ্রগতি হবে বলে কমিশনের বিশ্বাস। পাশাপাশি বিচারকদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, তারা কেবল আইনের ধারক নন, বরং ন্যায় ও সামাজিক পুনর্গঠনের প্রতীকও। তাই প্রধানমন্ত্রী বা সাধারণ বিক্রেতা—সব নাগরিকের জন্য সমান ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা বিচারকদের নৈতিক ও পেশাগত দায়িত্ব।
সব মিলিয়ে গুম কমিশনের এই প্রতিবেদন শুধুই তথ্যের সমাহার নয়, বরং এটি একটি যুগান্তকারী দলিল, যা বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দমননীতি এবং রাজনৈতিক শাসনের স্বরূপ নিয়ে গভীর আত্মজিজ্ঞাসা তৈরি করে। ভিন্নমতকে দমন করার যে কালচার দীর্ঘদিন ধরে চলছিল, তা যে কেবল সংবিধান ও মানবাধিকারের পরিপন্থী ছিল তাই নয়, বরং তা দেশের বিচার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে—এই বোধ থেকেই দেশকে পুনর্গঠনের আহ্বান জানিয়েছে কমিশন।