প্রকাশ: ০৫ই জুন ২০২৫ । আজকের খবর ডেস্ক । আজকের খবর অনলাইন
সাধারণত নেতা-মন্ত্রীদের আশপাশে ভিড় করে সুবিধা নেওয়ার প্রতিযোগিতা দেখা যায়। কেউ টাকা নিতে ব্যস্ত, কেউ ছবি তুলতে চায়, কেউ আবার সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু সম্প্রতি রাজধানীর এক ব্যস্তময় বিকেলে ঘটেছে এক ব্যতিক্রমী দৃশ্য, যা সারা দেশের মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। ঘটনাটি রাজনৈতিক বিতর্ক কিংবা বিশ্লেষণের বাইরে—এ যেন এক মানবিক, শিক্ষনীয়, এবং বিবেক জাগানিয়া মুহূর্ত।
রাজধানীর একটি ব্যস্ত সড়কে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার গাড়ি থামতেই চারদিকে ছুটে আসে নিরাপত্তা বাহিনী, সাংবাদিক, ক্যামেরা এবং কৌতূহলী জনতা। এ সময় আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ক্ষুধার্ত, রিক্ত, ঘরহীন ছেলেটির দিকে তাক করল কয়েকটি হাত—কারও হাতে কিছু টাকা, কেউ আবার ক্যামেরা দিয়ে তাকিয়ে আছে। তাকে বলা হয়, “এই নাও, কিছু টাকা রাখো।” কিন্তু সে অবাক করে দেওয়া জবাব দিল—“না, টাকা লাগবে না, দোয়া কইরেন।”
সেই পথশিশুর মুখে যখন শোনা গেল, “উনারা তো দেশ চালায়, আমি উনাদের কাছ থেকে টাকা নেব কেন? এই টাকা তো দুবেলা খেলেই শেষ হয়ে যাবে, মানুষ মন্দ বলবে”—তখন মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল চারপাশের কোলাহল। এক ক্ষুধার্ত, নিঃস্ব শিশু—যার ঠাঁই নেই কোথাও, বিছানা পথের ধুলো আর চাদর বাতাস—সেই শিশু আমাদের সবাইকে শিখিয়ে গেল নৈতিকতার শক্তিশালী পাঠ।
সে যা বলেছে, তা একটি সমাজব্যবস্থার গভীরে থাকা ঘুণপোকাকে তুলে ধরেছে। সে জানে—মানুষের সম্মান একবার হারালে, আর ফেরত পাওয়া যায় না। সে জানে—কারও থেকে সাহায্য নেওয়া মানেই নয়, সে দুর্বল; বরং সাহায্য প্রত্যাখ্যান করে আত্মসম্মান ধরে রাখা অনেক বড় শক্তি।
অন্যদিকে, আমাদের রাজনীতির চিত্র যেন সম্পূর্ণ বিপরীত। আজকাল ক্ষমতাসীন কিংবা বিরোধী—বেশিরভাগ নেতাদের লক্ষ্য একটাই: লুটপাট। তারা কিভাবে চাঁদা তুলবে, কতটুকু কমিশন খাবে, কার কাছ থেকে ঘুষ আদায় করা যাবে—এই হিসাবেই তাদের দিন কাটে। তারা মনে করে, জনগণের অর্থ তাদের ব্যক্তিগত সম্পদ, রাষ্ট্রের খাজাঞ্চি যেন কেবল তাদের জন্যই।
যদি তারা একটু থেমে ভাবত, “আমি যে টাকা নিচ্ছি, এটা আসলে এক কৃষকের ঘামে ভেজা ধান বিক্রির টাকা; এটা সেই শিশুর, যে স্কুলে যাওয়ার বদলে ইটভাটায় কাজ করে; এটা সেই মায়ের, যার সন্তান চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে”—তাহলে হয়তো তাদের বিবেক কিছুটা হলেও নাড়া খেত।
দুঃখের কথা হলো, আজ এই সমাজে একজন দরিদ্র শিশুর মধ্যে দেখা যায় সেই নৈতিকতা ও আত্মসম্মান, যা একজন তথাকথিত জাতীয় নেতার মাঝে দুর্লভ। আজ আমরা লাখ লাখ টাকা পাচারের খবর শুনি, দুর্নীতির কাহিনি জানি, তবুও তাদের মুখে কোনো অনুশোচনার ছাপ দেখি না। বরং তারা গর্ব করে, ঔদ্ধত্য দেখায়—যেন রাষ্ট্র তাদের পৈতৃক সম্পদ।
সেই শিশু হয়তো জীবনে বড় হতে পারবে না। তার হাতে থাকবে না কোনও সার্টিফিকেট, পেছনে থাকবে না ক্যাডার বাহিনী বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। সে কখনো হয়তো কোনো দলের মনোনয়ন পাবে না। কিন্তু তার যে কিছু আছে—তা কোটি টাকায় কেনা যায় না। তার আছে বিবেক, তার আছে আত্মসম্মান। এই আত্মসম্মানই তাকে এক অসাধারণ মানুষ করে তুলেছে।
দেশ বদলাবে, সমাজ বদলাবে, সেদিনই—যেদিন আমাদের নেতা-নেত্রীরা সেই টুকাই ছেলেটির মতো লজ্জা পাবে, চেতনার ঘুম ভাঙবে। যেদিন কেউ বলবে, “মানুষ মন্দ বলবে—আমি এমন টাকা চাই না।” সেদিন আমরা পাবো সত্যিকার অর্থে জনসেবক নেতা, পাবো নৈতিক রাজনীতি। সেই পথ দেখালো এক দরিদ্র পথশিশু, যাকে সমাজ আজও বলে ‘টুকাই’। কিন্তু প্রকৃত সম্মানের আসনে আজ সেই শিশুই বসে, আর আমরা তাকিয়ে দেখি—নিরবে, লজ্জায়।