শিরোনাম :
আকাশ ভেঙে আগুনের ঝরাপাত — ১৮৩৩ সালের সেই অলৌকিক উল্কাবৃষ্টি যেভাবে বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে নাড়া দিয়েছিল “শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে খুঁজে পায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ট্রাইব্যুনালের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ” উত্তরা হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যে ক্ষমতাবান পুলিশ কর্মকর্তা: দেশে থেকে পালিয়ে গেলেন বিদেশে – বিচারহীনতার রহস্য তামিম ইকবাল রাজনীতিতে যাত্রা শুরু নিয়ে যা বললেন নগরভবনে মেয়র ইশরাকের সভা অনুষ্ঠিত, তিনি পেলেন শুভেচ্ছা ও ক্রেস্ট ঈদযাত্রার ১৫ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩৯০ জন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলো ইরান, ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা নয় হজযাত্রী নিয়ে ভারতে উড়োজাহাজের চাকার সমস্যা, বের হলো ধোঁয়া ও আগুনের ফুলকি ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সাথে বৈঠকে মির্জা ফখরুল ট্রাইব্যুনালে হাজিরি দেন সাবেক আইজিপি মামুন

আকাশ ভেঙে আগুনের ঝরাপাত — ১৮৩৩ সালের সেই অলৌকিক উল্কাবৃষ্টি যেভাবে বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে নাড়া দিয়েছিল

আজকের খবর ডেস্ক
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ১৬ জুন, ২০২৫
  • ২২ বার

প্রকাশ: ১৬ই জুন ২০২৫ । আজকের খবর ডেস্ক । আজকের খবর অনলাইন

১২ই নভেম্বর, ১৮৩৩। ইতিহাসের পাতায় এক এমন রাত, যাকে বলা হয় “The Night the Stars Fell” — যে রাতে আকাশ যেন এক ঐশ্বরিক প্রদীপ হয়ে জ্বলে উঠেছিল। এই রাত শুধু উল্কাবৃষ্টির কারণে নয়, বরং এর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং বৈজ্ঞানিক অভিঘাতের কারণে আজও স্মরণীয়।

রাতটা শুরু হয়েছিল যথারীতি নিরবতায়। যুক্তরাষ্ট্রের বিস্তৃত কৃষিজমি, পাহাড়-ঘেরা জনপদ, ও শহুরে প্রান্তর—সবখানে মানুষ ছিলো নিদ্রায় আচ্ছন্ন। কিন্তু মধ্যরাতের একটু পর, আকস্মিকভাবে আকাশজুড়ে শুরু হয় আগুনের রেখার মতো উল্কার মিছিল। কল্পনা করুন, প্রতি মিনিটে শতশত আলোকরেখা ছুটে যাচ্ছে আকাশ জুড়ে—যেন মহাশূন্য নিজেই মানুষের সামনে এক মহাকাব্য রচনা করছে।

এই লিওনিড উল্কাবৃষ্টি ছিলো মানব ইতিহাসে এ যাবতকালের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং দৃশ্যমান উল্কাবৃষ্টি। নাসা ও স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে মাত্র ৯ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ২,৪০০০০টিরও বেশি উল্কাপাত রেকর্ড করা হয়। বোস্টনে প্রতি ঘণ্টায় ৭২,০০০ উল্কা দেখা গিয়েছিল, যা অবিশ্বাস্য এবং আজকের দিনের আধুনিক পর্যবেক্ষণ যন্ত্রেও বিরল।

সেই রাতে বহু মানুষ মনে করেছিল পৃথিবীর শেষ সময় এসে গেছে। কেউ গির্জায় ছুটেছে, কেউ খোলা মাঠে হাঁটু গেড়ে প্রার্থনায় বসেছে, আবার কেউ শিশুদের জড়িয়ে ধরে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে পড়েছে। দক্ষিণের অনেক দাসেরাও ভাবতে শুরু করে যে মুক্তির দিন এসে গেছে, অনেকেই তাদের মনিবদের ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। ইলিনয়ের এক পত্রিকায় বলা হয়, “The very heavens seemed ablaze” — যেন স্বর্গ জ্বলতে শুরু করেছে।

এই রাতটি ধর্মীয় জাগরণ আন্দোলনের জন্যও একধরনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে “Second Great Awakening” নামক ধর্মীয় পুনর্জাগরণ শুরু হয় মূলত এই রাতের অনুভূতি ও পরবর্তী ব্যাখ্যা থেকে।

১৮৩৩ সালের এই উল্কাবৃষ্টি বিজ্ঞানের ইতিহাসেও এক মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডেনিসন ওলমস্টেড সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতার বর্ণনা, চিঠিপত্র, দৈনন্দিন পর্যবেক্ষণ সংগ্রহ করে একটি প্রাথমিক বৈজ্ঞানিক ভিত্তি তৈরি করেন। তার পর্যবেক্ষণেই প্রথম জানা যায় যে উল্কাবৃষ্টির উৎপত্তি হয় মহাশূন্যে থাকা ধূমকেতুর ধূলিকণার ঝাঁক থেকে—সpecifically, 55P/Tempel–Tuttle নামক ধূমকেতুর কক্ষপথ থেকে ছড়িয়ে পড়া কণাগুলোর সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষের ফলেই এই বিস্ময়কর দৃশ্যের জন্ম হয়।

ওলমস্টেডের বিশ্লেষণ থেকে শুরু হয়েছিল ‘মেটেওর শাওয়ার’ বা উল্কাবৃষ্টি বিষয়ক বৈজ্ঞানিক চর্চা, যা আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে একটি বিশাল শাখা হিসেবে আজও প্রতিষ্ঠিত।

এই রাতের অভিঘাত শুধু বিজ্ঞান বা ধর্মে সীমাবদ্ধ ছিল না। লাকোটা ও ওজিবওয়ে জাতিসহ বহু আদিবাসী গোষ্ঠী এই রাতকে তাদের ক্যালেন্ডারে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা সময়কে ভাগ করে সেই রাতের আগে ও পরে বলে।

এমনকি আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন পরবর্তীতে বলেছিলেন, এই রাত তার বিশ্বাস ও রাজনৈতিক জগতে প্রবেশের জন্য এক প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। ফ্রেডেরিক ডগলাসের লেখাতেও এই রাতের উল্লেখ পাওয়া যায়—তিনি বলেছিলেন, “যখন আকাশ থেকে আগুন পড়ছিল, তখন মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ কিছুটা হলেও মুছে গিয়েছিল।”

প্রায় ২০০ বছর পেরিয়ে গেলেও, ১৮৩৩ সালের সেই উল্কাবৃষ্টি আজও মানুষকে বিস্ময়ে, ভাবনায় এবং জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ করে। আজকের দিনে, যখন মানুষ মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা করছে, সেই রাত মনে করিয়ে দেয়, আমাদের আদি বিস্ময়ের শিকড় সেই আকাশেই রয়ে গেছে।

আজও যদি আপনি কোনো নির্জন রাতে আকাশের দিকে তাকান, কোনো এক উল্কা হয়তো ছুটে যাবে মহাশূন্যে, আর আপনি হয়তো নতুন করে উপলব্ধি করবেন—আমরা কত ক্ষুদ্র, আর প্রকৃতি কত মহান।

প্রকৃতির এক রাতের উপহার কিভাবে মানুষের ধর্ম, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও আত্মোপলব্ধিকে নাড়িয়ে দিতে পারে, ১৮৩৩ সালের ১২ই নভেম্বর তার নিখুঁত দৃষ্টান্ত। এই রাত যেন এক মহাজাগতিক আয়না—যেখানে মানুষ বারবার ফিরে তাকায় এবং নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে।

তথ্যসূত্র:
নাসা, স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন, ইয়েল ইউনিভার্সিটি আর্কাইভ, American Journal of Science, The New York Times Historical Archive

নিউজটি শেয়ার করুন..

এ জাতীয় আরো খবর..

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২৫