প্রকাশ: ১২ই জুন, ২০২৫ • আজকের খবর ডেস্ক • আজকের খবর অনলাইন
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হওয়া বিপুল অঙ্কের অর্থ পুনরুদ্ধার নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনার ঝড় উঠেছে। ব্রিটিশ প্রভাবশালী দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের একটি প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কিছু বিতর্কিত ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে আর্থিক ‘সমঝোতায়’ যাওয়ার কথা ভাবছে। এ সংক্রান্ত তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর এবং সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি সরকারের সম্পদ পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে ড. মনসুর স্পষ্ট করেছেন, অপেক্ষাকৃত কম গুরুতর বা “নন-ক্রিমিনাল” অর্থপাচারের ঘটনাগুলোতে দেওয়ানি মামলা পরিচালনার মাধ্যমে আর্থিক সমঝোতা করার সম্ভাবনা বিবেচনাধীন। সরকারের লক্ষ্য এই সমঝোতার মাধ্যমে অন্তত ১০ কোটি মার্কিন ডলার সংগ্রহ করা, যা ভবিষ্যতের আন্তর্জাতিক মামলাগুলোর জন্য অর্থায়নে ব্যবহার করা হবে।
এই উদ্যোগকে কেন্দ্র করে আবারও সামনে এসেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিগত সরকারের শাসনামলে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রসঙ্গ। অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, গত ১৫ বছরে ক্ষমতার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো মিলে দেশ থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। শুধু একটি সরকার-নিযুক্ত শ্বেতপত্রেই অনুমান করা হয়েছে, এই অঙ্ক হতে পারে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি।
ড. আহসান মনসুর বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে সরকার নৈতিক ও আইনি দায়িত্ব পালনের পথ অনুসরণ করছে। তিনি বলেন, যেসব ক্ষেত্রে অপরাধ প্রমাণিত, সেসব ক্ষেত্রে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে তুলনামূলকভাবে হালকা মাত্রার আইনভঙ্গের ঘটনায় সমঝোতার সুযোগ রাখা হচ্ছে যাতে দেশের অর্থনীতি দ্রুত উপকৃত হতে পারে। একইসাথে তিনি এটাও জানান, কিছু অভ্যন্তরীণ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ইতোমধ্যেই জব্দ করা হয়েছে এবং বিদেশি সংস্থাগুলোর সাথে সমন্বয় করে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
অন্যদিকে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বিদেশে পাচার হওয়া এই অর্থ কোনো ব্যক্তি বা দলের নয়, এটি বাংলাদেশের মানুষের টাকা। তিনি যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, নৈতিক ও আইনগত দায়িত্ববোধ থেকে এই অর্থ শনাক্ত ও ফেরত পাঠাতে সহযোগিতা করা যুক্তরাজ্যের কর্তব্য। লন্ডনে তার চলমান সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য এই আন্তর্জাতিক সহায়তা নিশ্চিত করা।
ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন প্রশাসন ইতোমধ্যেই উচ্চ অগ্রাধিকারে ১১টি তদন্ত শুরু করেছে, যার বেশিরভাগই শেখ হাসিনা এবং তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক সহযোগীদের বিরুদ্ধে। অর্থপাচারের উৎস হিসেবে দেখানো হয়েছে ভুয়া ঋণ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অপব্যবহার এবং সরকারি অবকাঠামোগত প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাৎ।
এই প্রেক্ষাপটে সরকার অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে আইনের কঠোরতা ও কৌশলের ভারসাম্য রক্ষা করতে চাইছে বলে মনে করছে বিশ্লেষকরা। তবে বিষয়টি নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই সমঝোতার কৌশলকে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া বলে মনে করছেন, আবার কেউ কেউ বলছেন, অর্থ ফেরত আনার যে কোনো বাস্তবসম্মত পদক্ষেপই গ্রহণযোগ্য।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ এই পদক্ষেপকে ‘বাস্তববাদী’, আবার কেউ ‘নৈতিক আপোষ’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। তবে সর্বজনীন একমত এটাই যে, বাংলাদেশ থেকে যে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার হয়েছে তা ফিরিয়ে আনা দেশের অর্থনীতি ও জনকল্যাণের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
এই বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা মূল প্রশ্ন হলো—রাষ্ট্র কি অর্থপাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নীতিগত অবস্থান নেবে, নাকি অর্থ ফেরত আনার তাগিদে কার্যত চুক্তিভিত্তিক ছাড় দেবে? উত্তর খুঁজছে জাতি, তাকিয়ে আছে আন্তর্জাতিক সমাজও।