প্রকাশ: ১০ই জুন, ২০২৫ | নিজস্ব সংবাদদাতা | আজকের খবর অনলাইন
লন্ডন:
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মৌলিক নাগরিক অধিকার—ভোটাধিকার—নিশ্চিত করার জোর দাবি জানিয়ে এক শক্তিশালী বার্তা পৌঁছে দিল ‘প্রবাসী ভোটাধিকার বাস্তবায়ন পরিষদ ইউকে’। লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের আহ্বায়ক জজ মুহাম্মদ বেলায়েত হোসাইন এই দাবি উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, “দেড় কোটিরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশির পক্ষে আমরা আজ আমাদের ন্যায্য সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের আহ্বান জানাচ্ছি।”
সংবাদ সম্মেলনের বক্তৃতায় বেলায়েত হোসাইন বলেন, “স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রবাসীরা এখনও ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। সরকারে যারাই ছিলেন, তারা এই অধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও, তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। আর কতকাল প্রবাসীরা এই প্রতিশ্রুতির ফাঁদে পড়ে থাকবেন?” তিনি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত বর্তমান নির্দলীয় সরকার, যার নেতৃত্বে আছেন ড. মুহাম্মদ ইউনুস, এই দাবি বাস্তবায়নের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে পারেন।”
ড. ইউনুসের আসন্ন লন্ডন সফরকে ঘিরে প্রবাসীদের মধ্যে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, তাও উঠে এসেছে এই সম্মেলনে। বেলায়েত হোসাইন বলেন, “ব্রিটিশ রাজপরিবারের আমন্ত্রণে তাঁর এই সফর শুধু সম্মানের প্রতীক নয়, এটি আমাদের দাবিগুলো সরাসরি তুলে ধরার এক অনন্য সুযোগও বটে।” তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “যেভাবে ড. ইউনুস শাসন সংস্কারে বিভিন্ন কমিশন গঠন করে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জাতীয় সনদ তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছেন, তেমনি প্রবাসীদের ভোটাধিকারের বিষয়টিও তাঁর নজরে আসবে, এবং তিনি তা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন।”
এই সংবাদ সম্মেলনে একটি লিখিত বিবৃতিও পঠিত হয় পরিষদের পক্ষ থেকে। তা পাঠ করেন যুগ্ম আহ্বায়ক ব্যারিস্টার নাজির আহমেদ। এতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়, দেশের রেমিটেন্স নির্ভর অর্থনীতির অক্সিজেন সরবরাহ করেন যারা, তারা যেন ভোটাধিকার প্রয়োগ করে দেশের নেতৃত্ব নির্বাচনে মত দিতে পারেন। সভাটি পরিচালনা করেন পরিষদের সদস্য সচিব ব্যারিস্টার বদরে আলম দিদার।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন পরিষদের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, যাদের মধ্যে ছিলেন যুগ্ম আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম শাহীন, সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান, ব্যারিস্টার ইকবাল হোসাইন, আব্দুল মুনিম জাহেদী ক্যারল, ড. মোজাম্মেল হুসাইন, ড. শামসুল আলম গোলাপ, সাংবাদিক তৌহিদুল করিম মুজাহিদ এবং আব্দুল্লাহ আল মুনিম। উপস্থিত সকলের মাঝে ছিল এক ধরনের ঐক্যবদ্ধ প্রত্যয়—প্রবাসীদের এই মৌলিক অধিকারকে আর দাবির স্তরে আটকে রাখা যাবে না।
বক্তারা তাদের বক্তব্যে বিভিন্ন দেশের উদাহরণ টেনে বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলো, যুক্তরাজ্য, এমনকি মুসলিম দেশ তুরস্কেও প্রবাসীরা নিজ নিজ দেশের নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। তাহলে বাংলাদেশে কেন নয়? এই প্রশ্ন তুলেই বক্তারা সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তারা বলেন, প্রযুক্তির যুগে ইভোটিং, পোস্টাল ব্যালট বা অনলাইন রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা সময়ের ব্যাপার মাত্র—ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়।
তাঁরা মনে করিয়ে দেন, ইতিহাসে প্রবাসীদের অবদান কখনোই অস্বীকার করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধে লন্ডনের বাঙালি কমিউনিটির অর্থ সংগ্রহ থেকে শুরু করে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন, ৭১-এ প্রবাসীদের সহযোগিতাই ছিল দেশের স্বাধীনতার বড় পেছনের শক্তি। এরপর প্রতিটি রাজনৈতিক সংকটে, দুর্যোগে, আন্দোলনে প্রবাসীরা পাশে থেকেছেন দেশের। এমনকি সাম্প্রতিক রাজনৈতিক আন্দোলনেও অনেক প্রবাসী নিজেদের ভিসা হারিয়েছেন, গ্রেফতার হয়েছেন, শুধু দেশের গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য। তাই তারা শুধু অর্থনীতির নায়কই নন, দেশের নৈতিক শক্তিও।
বক্তারা আরও বলেন, “ড. ইউনুসের সরকার যদি সত্যিই সংস্কারে আন্তরিক হন, তাহলে ভোটাধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই সেই আন্তরিকতার বাস্তব প্রমাণ মিলবে।” সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন, প্রবাসীরা যেন আগামী জাতীয় নির্বাচনে বৈধভাবে ভোট দিতে পারেন, সেই ব্যবস্থা দ্রুত গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ সম্মিলিতভাবে কাজ করতে পারে। পরিশেষে তারা বলেন, “আমরা সরকারের শত্রু নই, আমরা সহযোগী হতে চাই। সহযোগিতার বিনিময়ে আমাদের অধিকারও নিশ্চিত হোক।”
এই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে প্রবাসী কমিউনিটিতে ব্যাপক সাড়া পড়ে গেছে। অনেকে মনে করছেন, বর্তমান সরকারের সংস্কারমুখী নীতিমালায় এই দাবিটি বাস্তব রূপ নিতে পারে। তবে সেটি নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছা ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর। এখন দেখা যাক, এই জনমতের প্রতি সরকার কতটা শ্রদ্ধাশীল থাকে।
প্রবাসী ভোটাধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, এই দাবি যতদিন না পূর্ণ হয়, ততদিন তারা দেশে ও বিদেশে সব সাংবিধানিক সীমার মধ্যে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাবে। সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার মনোভাব বজায় রেখেই তারা প্রবাসীদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।