প্রকাশ: ১০ ই জুন, ২০২৫ । নিজস্ব সংবাদদাতা । আজকের খবর অনলাইন
এ যেন শুধুমাত্র একটি ফুটবল ম্যাচ নয়, বরং জাতীয় আবেগ, দীর্ঘদিনের অপেক্ষা এবং নতুন স্বপ্নের এক সম্মিলিত বিস্ফোরণ। এএফসি এশিয়ান কাপ ২০২৭-এর বাছাইপর্বে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের আজকের প্রতিপক্ষ সিঙ্গাপুর। ঢাকার ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সন্ধ্যা সাতটায় ম্যাচ শুরু হলেও দুপুরের আগেই পুরো এলাকা পরিণত হয় এক উৎসবমুখর জনসমুদ্রে।
স্টেডিয়াম ঘিরে যে উত্তেজনা ও উদ্দীপনার ঢেউ উঠেছে, তা যেন অনেকটা ১৯৮০ কিংবা ৯০-এর দশকের সোনালি দিনের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। সকাল থেকেই ঢাকার গুলিস্তান মোড়, স্টেডিয়াম ঘিরে সড়ক, পাশের পার্কিং ও ফুটপাত জুড়ে ছিল হাজারো মানুষের জটলা—হাতে জাতীয় পতাকা, গায়ে জাতীয় দলের লাল-সবুজ জার্সি, কণ্ঠে স্লোগান আর মুখে গর্বিত প্রত্যয়।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) জানিয়েছে, ম্যাচ উপলক্ষে অনলাইনে ছাড়া হয় মোট ১৮ হাজার ৩০০টি টিকিট। টিকিট ছাড়ার পরপরই তা বিক্রি হয়ে যায়। অনেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনলাইনে চেষ্টা করেও টিকিট পাননি। যাঁরা গ্যালারিতে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা নিজেদের সৌভাগ্যবান ভাবছেন। এমনকি খেলার শুরু হওয়ার পাঁচ ঘণ্টা আগেই অনেকে গেটের সামনে দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষা করেছেন, যেন মাঠের সেরা মুহূর্ত মিস না হয়।
বেলা ২টার দিকে গেট খোলার কথা থাকলেও কিছুটা দেরিতে সীমিত আকারে দর্শকদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে জাতীয় স্টেডিয়ামের চারপাশে পরিণত হয় এক বিশাল জনসভায়, যেখানে ফুটবল ছিল কেবল উপলক্ষ, আর ভালোবাসাই ছিল প্রধান বার্তা।
সাধারণ দর্শকদের পাশাপাশি ছিল তরুণদের ব্যতিক্রমী অংশগ্রহণও। হামজা চৌধুরী অনুরাগী এক তরুণ নিজ চুল কেটে তার স্টাইলের হুবহু অনুকরণ করে উপস্থিত হন, যা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলোচনাও শুরু হয়। আরও চোখে পড়েছে একাধিক প্ল্যাকার্ড: “হামজা-শমিত-ফাহমিদুলের ঠিকানা; পদ্মা-মেঘনা-যমুনা” কিংবা “কোটি মানুষের প্রাণের সুর; বাংলার ফুটবল ফিরে আসুক”—এই ধরনের বার্তাগুলো ফুটবলকে ঘিরে মানুষের হৃদয়ের অবস্থান স্পষ্ট করে দেয়।
বিশ্বমানের নিরাপত্তার জন্য গেট খুলে দেওয়া হয় অনেক আগেই, কিন্তু সন্ধ্যা ৫টার পর স্টেডিয়ামে আর কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অতিরিক্ত ভিড় এবং নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, যাঁরা টিকিট পাননি বা ঢুকতে পারেননি, তাঁদের জন্যও রয়েছে খেলা উপভোগের বিকল্প ব্যবস্থা। দেশের আটটি বিভাগীয় শহর এবং ঢাকা মহানগরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বড় পর্দায় খেলা দেখার আয়োজন করেছে বাফুফে ও স্থানীয় উদ্যোক্তারা। টি-স্পোর্টস নিশ্চিত করেছে, ঢাকার ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর, চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম, রংপুর জেলা পরিষদ চত্বর, রাজশাহীর নানকিং বাজার, সিলেটের জিরো পয়েন্ট, খুলনার শিববাড়ি মোড় এবং বরিশালের বেল’স পার্কে বড় স্ক্রিনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পাশাপাশি, ঢাকার রূপনগর-পল্লবী এলাকায় সাবেক জাতীয় অধিনায়ক আমিনুল হকের উদ্যোগে ১২টি স্থানে খেলা সরাসরি দেখার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
২০২৭ সালে সৌদি আরবে বসতে যাওয়া এশিয়ান কাপের ১৯তম আসরে অংশ নিতে হলে এই বাছাইপর্বের প্রতিটি ম্যাচ গুরুত্বপূর্ণ। সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে জয় বাংলাদেশের জন্য কেবল তিন পয়েন্ট অর্জনের প্রশ্ন নয়, বরং এটি একটি প্রতীকী পুনরুত্থান—যা আবারও দেশকে ফুটবলের স্বর্ণালী অতীতে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়।
বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা এই ম্যাচকে ঘিরে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছে। কোচ জেভিয়ার কাবরেরার অধীনে দলটিতে এসেছে নতুন গঠন ও কৌশলগত পরিবর্তন। ইউরোপে খেলা তারকা ফুটবলার হামজা চৌধুরীর অভিষেক ম্যাচ হিসেবে এটিকে ঘিরে রয়েছে আলাদা উত্তেজনা। তাঁর সঙ্গে মিডফিল্ডে থাকবেন শমিত, ডিফেন্সে থাকছেন ইয়াসিন খান, ফরোয়ার্ড লাইনে গোলের জন্য অপেক্ষায় আছেন রাকিব হোসেন ও ফাহমিদুল।
আজকের ম্যাচ শুধুই একটি খেলাই নয়, বরং জাতির আত্মপরিচয়ের, ঐক্যবদ্ধ আকাঙ্ক্ষার এক বহিঃপ্রকাশ। এই উন্মাদনা প্রমাণ করে, বাংলাদেশের মানুষ এখনও বিশ্বাস করে—ফুটবলে আমাদের সম্ভাবনা অমিত, কেবল প্রয়োজন আন্তরিকতা, স্বচ্ছ পরিকল্পনা এবং নিরবচ্ছিন্ন সহানুভূতি।
সন্ধ্যা নামার আগেই শহরজুড়ে আলোড়ন তৈরি করেছে একটি প্রশ্ন—‘আজ কি ইতিহাস হবে?’ মাঠের ৯০ মিনিটের উত্তাপেই তার উত্তর লুকিয়ে।