প্রকাশ: ০৭ই জুন’ ২০২৫ । আজকের খবর ডেস্ক । আজকের খবর অনলাইন
গত ঈদুল আজহার দিন, রাজধানীর একটি অভিজাত এলাকার ঈদগাহে সম্পূর্ণ অনানুষ্ঠানিক, কিন্তু অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এক মুহূর্তের জন্ম হয়। নামাজ শেষে সবাই যখন কোলাকুলিতে ব্যস্ত, ঠিক তখন একজন সাধারণ মুসল্লী এগিয়ে এসে দেশের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে কানে কানে বলেন, “দালালদের কথা শুনবেন না স্যার।” দৃশ্যটি ছিল সংক্ষিপ্ত, বাকরুদ্ধ কিন্তু জোরালো এক বার্তা বহনকারী। কোনো মাইক্রোফোন ছিল না, ছিল না কোনো টিভি ক্যামেরা; কিন্তু ঘটনাটি মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে, সেখান থেকে প্রবেশ করে গণচেতনাতেও।
ঘটনার এই অনাড়ম্বরতা এবং ব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ততাই এই বাক্যকে এখন অনেক বড় রাজনৈতিক-সামাজিক প্রতীক হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠছে—একজন সাধারণ মানুষ এমন কথা কেন বললেন? কাদের ‘দালাল’ বলা হয়েছে এখানে? এবং কেন তিনি ড. ইউনূসের মতো একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বকে এইভাবে সচেতন করে দিলেন?
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, ইউনূস সাহেব অত্যন্ত বিনয়ের সাথে মুসল্লীটির কথা শুনে মাথা নেড়ে মৃদু হাসেন, কোনো উত্তেজনা প্রকাশ করেননি। কিন্তু এটিই যেন প্রকাশ করে দিল—ড. ইউনূসও জানেন, দেশের ভেতরে ও বাইরে তাঁকে ঘিরে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আইনি ঝড় বইছে, তা কেবল প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কারণে নয়; এর পেছনে রয়েছে গভীর রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং নানা গোষ্ঠীস্বার্থ।
বাংলাদেশে ড. ইউনূস দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। একদিকে তিনি ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের একজন বিশ্বমান্য রূপকার, অন্যদিকে দেশের বর্তমান সরকার বারবার তাঁকে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করে আদালতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে কর ফাঁকি, শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন, এমনকি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নের মতো নানা অভিযোগ এনেছে রাষ্ট্রের আইন ও প্রশাসনিক মহল। যদিও এই সব অভিযোগের একটি বড় অংশ এখনো আদালতে প্রমাণিত হয়নি, তা সত্ত্বেও তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরি হয়ে গেছে।
এই প্রেক্ষাপটে ঈদের দিনের সেই একাত্মতা প্রকাশ—‘দালালদের কথা শুনবেন না’—একটি ব্যাপক জনপ্রতিরোধের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ দেশে সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ বিশ্বাস করে, ড. ইউনূসকে যেভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে, তা অনৈতিক, অমানবিক এবং দেশের মর্যাদা বিরুদ্ধ। কেউ কেউ মনে করেন, ২০০৬-২০০৮ সময়কালে তাঁর রাজনৈতিক উদ্যোগ এবং আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা তাঁকে বর্তমান ক্ষমতাধরদের কাছে হুমকি হিসেবে প্রতিস্থাপন করেছিল।
বাংলাদেশের মূলধারার কিছু গণমাধ্যম ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীও, যাদের সাথে ক্ষমতাসীনদের সম্পর্ক জোরালো, বিভিন্ন সময় তাঁর ভাবমূর্তি নষ্ট করার প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছে। সেই প্রক্রিয়ায় কিছু ‘দালাল’ গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে বলেই ধারণা সাধারণ মানুষের। যারা সরাসরি তাঁকে ঠেকাতে পারে না, তারা প্রোপাগান্ডা, অপপ্রচার ও আইনি হেনস্তার মাধ্যমে তাঁকে কোণঠাসা করতে চায়—এমনটাই বিশ্বাস অনেক বিশ্লেষকের।
ঈদের নামাজের পরে একজন ধর্মপ্রাণ মুসল্লীর পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য আসা মানে—মানুষ শুধু রাজনৈতিক দলের ভাষায় নয়, নৈতিক অবস্থান থেকেও চিন্তা করতে শিখেছে। তারা এখন বুঝে—কে নিজের স্বার্থে কথা বলে আর কে জাতীয় স্বার্থের কথা বলে। একজন মুসল্লীর কয়েক সেকেন্ডের মন্তব্য পুরো একটা জাতির মনের গহীন কথাকে যেন রূপ দিল প্রকাশ্যে।
ড. ইউনূসের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি বা ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে বিতর্ক যাই থাকুক, তাঁর প্রতি সাধারণ মানুষের যে নির্ভরতা ও সম্মান এখনও অক্ষুণ্ন রয়েছে, তা আবারও প্রমাণ হলো এই ঈদের দিনের ঘটনার মধ্য দিয়ে। তাঁর অবস্থান আজ দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় যেন এক ধরনের নৈতিক পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে—কে সত্যের পাশে, আর কে কৃত্রিম সৃষ্ট ‘দালাল’ ন্যারেটিভের অংশ।
আমাদের সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ সংকটে এই ধরণের ছোট ছোট ঘটনাই হয়তো আবারও মানুষকে মনে করিয়ে দিচ্ছে—বড় কিছু এখনও সম্ভব, এবং এখনও দেশের বিবেক জাগ্রত।
আজকের খবর অনলাইন মনে করে, একজন মানুষ কাকে সমর্থন করেন বা না করেন, সেটা নয় বরং কী মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করেন সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। ড. ইউনূসের জন্য ঈদের দিনে একজন সাধারণ মানুষের এই উদাত্ত বার্তা এক অমূল্য সামাজিক চেতনার প্রতিফলন, যেটি এই দুঃসময়ে প্রেরণার উৎস হয়ে উঠতে পারে।