প্রকাশ: ১৩ই জুন, ২০২৫ • আজকের খবর ডেস্ক • আজকের খবর অনলাইন
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক যুক্তরাজ্য সফরকে ঘিরে সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আলজাজিরা সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের-এর ফেসবুক পেজ থেকে প্রাপ্ত তথ্য, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের অনুসন্ধানী রিপোর্ট একত্রে মিলিয়ে একটি সুস্পষ্ট প্রশ্ন সামনে এসেছে—দেশের স্বার্থে এই সফরের আসল প্রাপ্তি কী? এবং এত বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় অর্থ খরচ করে কী অর্জন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে?
প্রসঙ্গত, ড. ইউনূস ও তাঁর ৩৮ সদস্যের সফরদল গত ৯ জুন লন্ডন শহরে পৌঁছে অবস্থান নেন বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল হোটেল ‘দ্য ডরচেস্টার’-এ। ওই হোটেলে চার রাতের জন্যে ৩৭টি কক্ষ বুক করা হয়, যার মোট খরচ দাঁড়ায় ২১০,৩২৫ ব্রিটিশ পাউন্ড—বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৩ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা। একমাত্র প্রধান উপদেষ্টার ব্যবহৃত কক্ষটির দৈনিক ভাড়া ছিল ৬,০৪৫ পাউন্ড, অর্থাৎ প্রায় ১০ লক্ষ টাকা, এবং পুরো চার রাতের জন্যে শুধুমাত্র তাঁর ঘরের বিলই দাঁড়িয়েছে ২৪,১৮০ পাউন্ড বা প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা।
এই বিশাল ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে সমালোচনা বাড়ছে, বিশেষত যখন সফরের মূল উদ্দেশ্য ও কূটনৈতিক অর্জন পরিষ্কার নয়। ইউনূস ব্রিটিশ রাজার কাছ থেকে একটি ব্যক্তিগত সম্মাননা গ্রহণ করেছেন, যা নিঃসন্দেহে সম্মানের বিষয়, তবে তা রাষ্ট্রীয় বা কূটনৈতিক অর্জন নয়। সফরে কোনো দ্বিপাক্ষিক বৈঠক, চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়নি বলেই নিশ্চিত হওয়া গেছে। এমনকি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে, যা ফিন্যান্সিয়াল টাইমস তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।
সেই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকার আমলে দেশ থেকে পাচার হওয়া কোটি কোটি ডলার উদ্ধারের লক্ষ্যে এই সফরকালে ইউনূস আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চেয়েছেন। তিনি যুক্তরাজ্যসহ কানাডা, সিঙ্গাপুর, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল ও মধ্যপ্রাচ্যকে পাচারকৃত সম্পদের সম্ভাব্য গন্তব্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু এই সফরের সময় যুক্তরাজ্য সরকারের কাছ থেকে বাস্তবসম্মত কোনো প্রতিশ্রুতি আদায় হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে এখনো স্পষ্ট কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
ইউনূস নিজে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, যুক্তরাজ্যের উচিত “আইনি ও নৈতিকভাবে” বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা করা, কারণ এ অর্থ “চুরি করা হয়েছে” এবং এর বেশিরভাগই যুক্তরাজ্যে রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। যদিও তিনি আশাবাদ প্রকাশ করেছেন যে যুক্তরাজ্য সরকার অর্থ খুঁজে পেতে সহায়তা করছে, তবে এখন পর্যন্ত কোনো চুক্তি, চিঠিপত্র বা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পাওয়া যায়নি।
এই প্রেক্ষাপটে আরও প্রশ্ন উঠেছে যাতায়াত সংক্রান্ত খরচ নিয়ে। যদিও বাংলাদেশ বিমানের সরাসরি লন্ডন রুটে ফ্লাইট রয়েছে, তবুও ড. ইউনূস ও তাঁর সফরসঙ্গীরা ভ্রমণ করেছেন এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফার্স্ট ও বিজনেস ক্লাসে। এমিরেটসের টিকিটের খরচ বাংলাদেশ বিমানের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। জাতীয় পতাকাবাহী সংস্থাকে পাশ কাটিয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও অর্থনৈতিক সংবেদনশীলতার প্রশ্ন তোলে।
এই সফরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ সম্পর্কেও তথ্য সামনে এসেছে, যা অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা আলোচনা সৃষ্টি করেছে। এ ধরনের সাক্ষাৎ কি ব্যক্তিগত ছিল, না কি কোনো রাজনৈতিক সমন্বয় বা বার্তা বহন করছিল—তা নিয়ে সরকারপক্ষ কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।
যেখানে দেশের অর্থনীতি চাপে, যেখানে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার লক্ষ্যে প্রতিটি পদক্ষেপ হিসেব করে নেওয়া জরুরি, সেখানে একটি রাষ্ট্রীয় সফরের এত উচ্চ ব্যয় ও সীমিত কূটনৈতিক অর্জন যৌক্তিকতা হারায়। এই সফর রাষ্ট্রের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও অর্থনৈতিক সচেতনতার প্রশ্নে এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। জনগণ জানতে চায়—এই সফরের প্রকৃত প্রাপ্তি কী? বিদেশে চুরি যাওয়া সম্পদ ফেরত আনতে কি বাস্তব কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, নাকি বিলাসিতা ও আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে এই বহুল আলোচিত সফর?
এই মুহূর্তে উত্তর খোঁজার দায় সরকারের। এবং সেই উত্তর হতে হবে স্বচ্ছ, পরিপূর্ণ এবং জাতির প্রতি দায়বদ্ধতার অনুরূপ।