প্রকাশ: ১১ ই জুন, ২০২৫ । নিজস্ব সংবাদদাতা । আজকের খবর অনলাইন
লন্ডনের পূর্ব প্রান্তের প্রাণকেন্দ্র আলতাব আলী পার্ক মঙ্গলবার বিকেলে যেন রূপ নিয়েছিল এক আনন্দোৎসবের মঞ্চে। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝে বিরল ঐক্যের এক দৃশ্যপট রচিত হয় এই দিনটিতে। রাজপরিবারের আমন্ত্রণে পুরস্কার গ্রহণ করতে সকালে লন্ডনে পৌঁছানো গণঅভ্যুত্থানে গঠিত সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে স্বাগত জানাতেই এই মানবসমাবেশ। একালের রাজনীতিতে দলমতনির্বিশেষে এমন স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ বিরল—আরও বিরল, যখন তা হয় প্রবাসে।
যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি কমিউনিটির রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসে আলতাব আলী পার্ক বহু গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশের সাক্ষী। তবে গতকালের সমাবেশটি আলাদা গুরুত্ব বহন করে। এর পেছনে ছিল না কোনো রাজনৈতিক দলের আনুষ্ঠানিক আহ্বান, ছিল কেবল একটি সামাজিক উদ্যোগ—যার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দলমত নির্বিশেষে হাজারো প্রবাসী বাংলাদেশি রাস্তায় নেমে আসেন। পার্কজুড়ে মানুষের ঢল, হাতে হাতে ফেস্টুন ও ব্যানার, গলায় শ্লোগান—সব মিলিয়ে পুরো এলাকা রূপ নেয় আন্দোলনের অনন্য এক মঞ্চে।
বিকাল ৫টার আগেই সমবেত হতে থাকেন মানুষ। সময় গড়ানোর সাথে সাথে যেন জনস্রোত উপচে পড়ে সমাবেশস্থলে। শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা—‘দিল্লি না ঢাকা?’—সমবেত কণ্ঠে জবাব আসে, ‘ঢাকা-ঢাকা’। আবার উঠে, ‘নির্বাচন না সংস্কার?’—উত্তরে তুমুল স্বরে প্রতিধ্বনি হয়, ‘সংস্কার-সংস্কার’। উপস্থিত জনতার উচ্ছ্বাসে বোঝা যায়, তারা এক নতুন ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় উদগ্রীব।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন গ্রেটার সিলেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ব্যারিস্টার আতাউর রহমান এবং যুক্তরাজ্যে প্রবাসী প্রবীণ সমাজসেবক সিরাজ হক। আয়োজনে সহায়তা করেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটির বিভিন্ন পেশার মানুষ, মানবাধিকার সংগঠন এবং সামাজিক কর্মীরা। সংগঠনগুলোর মধ্যে ‘রিফর্ম বাংলাদেশ’ এবং ‘স্ট্যান্ড উইথ ইউনূস’ ব্যানার ছিল নজরকাড়া। এতে করে স্পষ্ট হয়, প্রবাসী সমাজের এক বড় অংশ বর্তমান সরকারের সংস্কারমূলক কার্যক্রমের প্রতি আস্থা রেখেছে এবং তা তারা সর্বসম্মতভাবে সমর্থনও জানাতে প্রস্তুত।
বক্তব্য পর্বে অংশ নেন চিকিৎসক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ, তরুণ সমাজকর্মীসহ সমাজের নানা স্তরের মানুষ। বক্তব্যের মূল সুর ছিল শাসন ব্যবস্থায় অবিলম্বে প্রয়োজনীয় সংস্কার, দায়মুক্তির সংস্কৃতি থেকে মুক্তি এবং ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে পতিত সরকারের অপরাধের বিচার। বিশেষ করে শেখ হাসিনাসহ তাঁর শাসনকালীন অপরাধের নিরপেক্ষ বিচার কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই—এই দাবিটিই সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়।
এই বিশাল সংহতির বিপরীতে একই দিন সকালে সেন্ট্রাল লন্ডনের রোচেস্টার হোটেলের সামনে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখা বিক্ষোভ ও কালো পতাকা প্রদর্শনের কর্মসূচি পালন করে। ড. ইউনূসের লন্ডন আগমনের সময় ওই হোটেলেই অবস্থান করছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের কর্মসূচির খবর ছড়িয়ে পড়তেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বহু সাধারণ প্রবাসীও হোটেল চত্বরে জড়ো হন তাঁকে স্বাগত জানাতে। তবে আলতাব আলী পার্কের সমাবেশটি ছিল পূর্বনির্ধারিত এবং আয়োজিত এক বড় আয়োজন।
সমাবেশ থেকে যেসব দাবি উত্থাপন করা হয়, তার মধ্যে ছিল—প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, দ্বৈত নাগরিকদের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের আইনগত সুযোগ তৈরি, দেশে প্রবাসীদের সম্পত্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, এবং সিলেট ওসমানি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তরের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন।
এদিকে জানা গেছে, আগামী শুক্রবার সকালেই প্রধান উপদেষ্টার অবস্থানরত হোটেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এই বৈঠককে ঘিরে বিএনপির যুক্তরাজ্য শাখাও হোটেল প্রাঙ্গণে উপস্থিত হবে। তবে পার্টির পক্ষ থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে, যেন কোনো ধরনের ব্যানার, প্ল্যাকার্ড বা রাজনৈতিক প্রতীক না থাকে উপস্থিতদের হাতে।
প্রবাসে বাংলাদেশি রাজনৈতিক সংস্কৃতির এমন পরিণত, সম্মিলিত ও শান্তিপূর্ণ রূপ সচরাচর দেখা যায় না। আলতাব আলী পার্কের এই গণজমায়েত প্রমাণ করলো, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং শাসন সংস্কারের পক্ষে প্রবাসীদের প্রত্যাশা যেমন স্পষ্ট, তেমনি তারা এই প্রত্যাশা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণে পিছপা নয়। অধ্যাপক ইউনূসের এই সফর তাই শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়—বরং ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নির্মাণে প্রবাসী সমাজের সংকেত।