প্রকাশ: ০৭ই জুন ২০২৫ । আজকের খবর ডেস্ক । আজকের খবর অনলাইন
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি (বিএমএ)-তে নবীন কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারদের স্যালুট গ্রহণ করেন ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মানোজ পান্ডে। এই ঘটনাটি শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিক প্রটোকল নয়—বরং তা জাতীয় নিরাপত্তা, সামরিক নিরপেক্ষতা ও কৌশলগত স্বাধীনতা নিয়ে এক গভীর ভাবনার অবকাশ সৃষ্টি করেছে।
ঘটনাটি নতুন নয়, তবে তা নিয়ে আলোচনা নতুন করে আলোড়ন তুলেছে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোস্তাফিজুর রহমান (অব.)-এর একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে, যা তিনি মূলত প্রথম লিখেছিলেন ৭ জুন ২০২৩ সালে। সামরিক কৌশল, প্রশিক্ষণপদ্ধতি, এবং ভারতের ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ বিশ্লেষণ দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক কৌশলগত নীতিতে এক তীব্র সমালোচনার জানালা খুলে দেয়।
সাবেক এই প্যারা কমান্ডো কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ন্যারেটিভে ‘Wolfland’ ও ‘Greenland’ নামের কাল্পনিক রাষ্ট্রের মাধ্যমে যেসব কৌশলগত অনুশীলন করানো হতো, সেখানে Wolfland-এর আচরণ ছিল “big brotherly”—যা সরাসরি ভারতের ভূ-রাজনৈতিক প্রবণতার সঙ্গে মিলে যায়। প্রশিক্ষণকালে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় অফিসাররাও সহজেই বুঝে নিতো, Wolfland মানে ভারত। কিন্তু কূটনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখে এ প্রসঙ্গে কেউ প্রকাশ্যে কথা বলত না।
বাংলাদেশ সরকার ভারতকে ‘বন্ধু রাষ্ট্র’ হিসেবে পরিচয় দেয়। তবে বাস্তবতা ভিন্ন; প্রতিবছর বিএসএফ গুলি করে হত্যা করে ৪০ থেকে ৬০ জন বাংলাদেশিকে। ট্রানজিট ইস্যুতে বাংলাদেশ ভারতের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের সুবিধা দিলেও ভারত বাংলাদেশকে একই ধরণের সুবিধা দিতে নারাজ। আর দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি—যেটি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ৫ বিলিয়ন ডলার—২০২৫ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১৪ বিলিয়ন ডলারে। বন্ধুত্বের এ অসম “হিসাব” কীভাবে মানানসই, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ভারতের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রবণতা। ভারতের নতুন সংসদ ভবনে স্থাপিত অখণ্ড ভারতের ম্যুরাল, আরএসএস-এর রাজনৈতিক মতাদর্শ, এবং প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোকে তাদের আদি ভূখণ্ডের অংশ হিসেবে কল্পনা করা—এসব কিছুর মূলে রয়েছে একটি সম্প্রসারণবাদী মনোভাব। ভারতের কট্টর ডানপন্থী রাজনীতি বরাবরই মনে করে, বাংলাদেশ একদিন তাদের “অখণ্ড ভারতের” অংশ হবে—সেখানে মুসলমানদের ভোটাধিকার থাকবে না, থাকবে না স্বাধীন জাতিসত্তার চর্চাও।
মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ২০১১ সালে তিনি যখন ১ প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ছিলেন, সে সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথ কমান্ডো প্রশিক্ষণে অংশ নেন। ২০১২ সালে তাঁর ইউনিট ভারত সফরে যায়। প্রশিক্ষণ শেষে দীর্ঘ ডিব্রিফিংয়ে অংশ নিয়ে তিনি উপলব্ধি করেন—ভারত তাদের সামরিক কাঠামো আমূল পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে। তারা ১৬টি পদাতিক ব্যাটালিয়নকে প্যারা ইনফ্যান্ট্রি ইউনিটে রূপান্তর করছে। এই ইউনিটগুলো যুদ্ধকালীন সময়ে প্যারাড্রপের মাধ্যমে শত্রু অঞ্চলে ঢুকে সশস্ত্র তৎপরতায় নিয়োজিত থাকবে।
এই অবস্থায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেও চাপ সৃষ্টি হয় অনুরূপ কৌশলগত পরিবর্তনের জন্য। সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের পর জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়ার ভারত সফর শেষে সেনাসদরে আলোচনার সূত্রপাত হয়—বাংলাদেশেরও কয়েকটি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়নকে প্যারা ইনফ্যান্ট্রি ইউনিটে রূপান্তর করা হবে কি না। মোস্তাফিজুর রহমান সেই সময় সেনাসদরের এক স্টাফ অফিসারের সঙ্গে আলোচনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন—বাংলাদেশ যেখানে বছরে একজন কমান্ডোকে মাত্র দুটি রুটিন প্যারাজাম্প করাতেই হিমশিম খায়, সেখানে কিভাবে রেগুলার ব্যাটালিয়নকে প্যারাবেসড ইউনিটে রূপান্তর করা হবে?
তিনি বিষয়টি নিয়ে একটি বিশদ প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, তখন দেশে ২,৬০০ প্রশিক্ষিত কমান্ডো ছিলেন। প্রয়োজনীয় ওয়েস্টেজ বাদ দিয়েও দুটি নতুন কমান্ডো ব্যাটালিয়ন গঠন সম্ভব ছিল। তাহলে কেন অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও এয়ার এসেট ছাড়াই রেগুলার ইনফ্যান্ট্রি ইউনিটকে কৌশলগত রূপান্তরের পথে ধাবিত করা হবে?
এই ঘটনাগুলো শুধু প্রশিক্ষণ কাঠামো নয়, বরং বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক প্রভাব ও নেতৃত্বের পররাষ্ট্র কৌশলের প্রতিফলন—এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্যালুট একটি প্রতীকী কর্ম হলেও, তা যে দেশের স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা এবং কৌশলগত অবস্থানকে প্রতিনিধিত্ব করে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
একজন ভারতীয় সেনাপ্রধান যখন বাংলাদেশের সামরিক ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চে দাঁড়িয়ে নবীন অফিসারদের স্যালুট গ্রহণ করেন, তখন তা নিছক বন্ধুত্ব নয়, বরং এক প্রকার মানসিক ও নীতিগত “সমর্পণ” বলেই ধরে নিচ্ছেন বহু প্রাক্তন সেনা সদস্য।
আজকের বাংলাদেশে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে যেসব প্রশ্ন জন্ম নিচ্ছে, তা আর শুধু সীমান্ত বা সামরিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। রাষ্ট্রের কূটনীতি, রাজনীতি, সামরিক পরিকল্পনা এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতা—সবকিছুর মধ্যে এই প্রশ্নগুলো বেঁচে থাকবে।
আজকের খবর অনলাইন মনে করে, একটি দেশের আত্মমর্যাদা ও কৌশলগত স্বাধীনতা রক্ষার জন্য কূটনৈতিক সৌজন্য ও বাস্তবসম্মত রাষ্ট্রনীতি সমন্বয় করেই এগোতে হবে। শুধু ‘বন্ধু’ বললেই বন্ধুত্ব প্রমাণ হয় না, আত্মমর্যাদার প্রশ্নে আপোষ নয়—সেটাই হতে হবে রাষ্ট্রীয় অবস্থান।