আজকের খবর অনলাইন
প্রকাশ: ১ জুন ২০২৫
নিজস্ব প্রতিবেদক
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক নিপীড়নের মুখে ২০১৭ সালের শেষার্ধে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা গণপ্রবাহ আজও বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি, সমাজ এবং সর্বোপরি সার্বভৌমত্বের ওপর এক স্থায়ী চাপ হিসেবে বিরাজমান। লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আশ্রয়গ্রহণের প্রাথমিক মানবিক আবেদনের জায়গাটি এখন ক্রমেই একটি জটিল কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত সংকটে রূপ নিয়েছে। আর এই সংকট সমাধানের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও বাস্তবসম্মত কৌশলের অভাব ক্রমেই জাতিকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
নৃশংস গণহত্যার মুখে জীবন বাঁচাতে রোহিঙ্গারা যখন আরাকান ছেড়ে বাংলাদেশের সীমান্তে এসে আশ্রয় নেয়, তখন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রক্ষার আদর্শ অনুসরণ করে তাদেরকে সুরক্ষা দেয়। কিন্তু বিগত সরকারগুলোর নিষ্ক্রিয়তা, প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের স্বার্থ রক্ষায় পক্ষপাতদুষ্ট কূটনৈতিক কৌশল এবং আন্তর্জাতিক মহলের অগ্রহণযোগ্য নির্লিপ্ততা—সমগ্র রোহিঙ্গা সংকটকে বছরের পর বছর স্থবির করে রেখেছে। বারবার প্রত্যাবাসনের প্রতিশ্রুতি উচ্চারিত হলেও বাস্তবতা বলছে, রোহিঙ্গারা আজও বাংলাদেশের মাটিতে রাষ্ট্রহীন, শেকড়হীন ও নির্ভরশীল এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের যাত্রী।
এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে একটি সুসংহত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন ‘হিউম্যানিটারিয়ান চ্যানেল’ নামে একটি কৌশলগত মানবিক করিডোর বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে, যা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে একটি পর্যায়ক্রমিক, নিরাপদ এবং সম্মানজনক প্রক্রিয়ায় রূপান্তর করার প্রয়াস।
তবে এই মানবিক করিডোর নিয়ে অনেকে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন। কিছু মহল এটিকে ভারতের সঙ্গে করা ভূরাজনৈতিক ছাড় বা করিডোরের মতো মনে করছেন। কিন্তু বাস্তবে এটি কোনো প্রকার রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমতা হস্তান্তর নয়। বরং এই ‘হিউম্যানিটারিয়ান চ্যানেল’ আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী একটি স্বীকৃত ব্যবস্থা, যা সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে নিরস্ত্র বেসামরিক জনগোষ্ঠী, ত্রাণ ও সেবা সংস্থার নিরাপদ চলাচলের পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘অপারেশন সি এঞ্জেলস’-এর সঙ্গেও তুলনীয়, যেখানে যুদ্ধ নয়, বরং মানবিক সহায়তার প্রয়োজনে বিদেশি সামরিক ও বেসামরিক সহায়তা ব্যবহৃত হয়েছিল।
এই ধরনের ‘যুদ্ধ বহির্ভূত সামরিক কার্যক্রম’ (Military Operations Other Than War) এখন বিশ্বজুড়েই বাস্তবতা। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যে নাগরিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পরিচালিত বহুপাক্ষিক প্রচেষ্টা তার প্রমাণ। বাংলাদেশের মতো একটি কৌশলগত অবস্থানে থাকা রাষ্ট্রের জন্য রোহিঙ্গা সংকট কেবল একটি মানবিক সমস্যা নয়, এটি স্পষ্টভাবেই একটি কৌশলগত নিরাপত্তা ইস্যু এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন।
এই বাস্তবতায় সশস্ত্র বাহিনীর অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি সশস্ত্র বাহিনী এই সংকট সমাধানের জন্য সরকারের গৃহীত নীতিমালার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে, তাহলে জাতির সামনে তাঁদের লক্ষ্য, মত ও অবস্থান স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা আবশ্যক। কারণ সশস্ত্র বাহিনী ও জাতীয় নেতৃত্বের মধ্যে দূরত্ব কিংবা অনির্দিষ্টতা কেবল অভ্যন্তরীণ বিভ্রান্তি নয়, বরং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিসরেও বিভ্রান্তি ও দুর্বলতা সৃষ্টি করে। কৌশলগত কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কৌশলগত যোগাযোগ বা স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন অত্যাবশ্যক।
সর্বশেষ তথ্যমতে, সীমান্তে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নতুন করে সক্রিয়তা, গোলাবর্ষণ ও সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনাগুলো উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে। অন্যদিকে কিছু প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে ‘পুশ ইন’ বা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেয়ার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত মিলছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে স্থায়ী সমাধানে রূপান্তর করা না গেলে বাংলাদেশ এই অঞ্চলের রাষ্ট্রহীন মানুষের ভাগাড়ে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্ত হতে পারবে না।
সার্বভৌমত্ব কোনো নীতিনির্ধারকের বিলাসিতা নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রশ্ন। এই প্রশ্নে বিভ্রান্তি, বিলম্ব কিংবা দ্বিধার কোনো সুযোগ নেই। তাই বর্তমান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ যদি মানবিক, বাস্তবমুখী ও আন্তর্জাতিক আইনানুগ হয়, তাহলে তা আমাদের সম্মিলিত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত।
এই সংকটে কোনো বৈরী রাষ্ট্র বা কৌশলগত প্রতিপক্ষের অপপ্রচারের অনুসারী বা বাহন হওয়া জাতির জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। তাই এখন প্রয়োজন—রাষ্ট্র, সেনাবাহিনী, প্রশাসন ও জনগণের মধ্যে ঐকমত্য ও সংহতি। রোহিঙ্গা সংকটের একটি সম্মানজনক ও কার্যকর সমাধান আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের সুরক্ষায় এখন সবচেয়ে জরুরি ও অনিবার্য চ্যালেঞ্জ। জাতিকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সাহসিকতা, প্রজ্ঞা ও ঐক্য নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।