প্রকাশ: ১লা জুলাই, ২০২৫ | আজকের খবর ডেস্ক | আজকের খবর অনলাইন
যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে অন্যতম চাঞ্চল্যকর ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মামলায় নতুন মোড় যুক্ত হয়েছে, যখন লুসি লেটবির অপরাধ সংশ্লিষ্টতার দায়ে এখন হাসপাতালের তিনজন সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে গুরুতর অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডের সন্দেহে। গত কয়েক বছরে এই মামলাটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে যেমন আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, তেমনি প্রশ্নের মুখে ফেলেছে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, বিচার ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় নজরদারি কাঠামোকেও।
৩৫ বছর বয়সী নার্স লুসি লেটবি কাউন্টেস অফ চেস্টার হাসপাতালের নবজাতক ইউনিটে কর্মরত অবস্থায় ২০১৫ সালের জুন থেকে ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে সাতটি শিশুকে হত্যা এবং আরও সাত শিশুকে হত্যার চেষ্টার জন্য দোষী সাব্যস্ত হন। ২০২৩ সালে ম্যানচেস্টার ক্রাউন কোর্টে বিচার শেষে তাকে আজীবনের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এমনকি পুনর্বিচারেও তাঁর বিরুদ্ধে আরও একটি শিশুকে হত্যার চেষ্টার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এর ফলে, লেটবি বর্তমানে ১৫টি যাবজ্জীবন দণ্ড ভোগ করছেন এবং তার কোনো আগাম মুক্তির সম্ভাবনা নেই।
তবে এই ঘটনার পর থেকেই জনমনে প্রশ্ন ছিল, কীভাবে একজন নার্স এতদিন ধরে এই ভয়াবহ অপরাধ চালিয়ে যেতে পারলেন, অথচ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা নজরে আনতে ব্যর্থ হল? সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজতেই ব্রিটিশ পুলিশ ও তদন্ত সংস্থাগুলো শুরু করে ব্যাপক তদন্ত। এই তদন্তের অংশ হিসেবেই এই সপ্তাহে, হাসপাতালে তৎকালীন সিনিয়র নেতৃত্বে থাকা তিনজন সাবেক কর্মকর্তাকে গুরুতর অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ জানায়, ৩০ জুন সোমবার এই গ্রেপ্তার কার্যকর হয় এবং পরে তাদের তদন্ত চলাকালীন শর্তসাপেক্ষে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়।
চেশায়ার কনস্টাবুলারির অধীনে গঠিত অপারেশন ডুয়েট নামের বিশেষ তদন্তকারী দলটির নেতৃত্বে থাকা গোয়েন্দা সুপারিনটেনডেন্ট পল হিউজেস জানান, এই তদন্তের মূল লক্ষ্য ছিল কর্পোরেট স্তরে দায়দায়িত্ব নিরূপণ করা। বিশেষ করে, হাসপাতালের শিশুমৃত্যুর হারের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পরও কেন তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলেন—সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এখন তদন্ত আরও গভীরতর হচ্ছে।
লেটবির অপরাধের ধরন ছিল ভয়ঙ্কর। শিশুর শরীরে ইচ্ছাকৃতভাবে বাতাস ঢুকিয়ে দেয়া, বিষাক্ত ইনজেকশন প্রয়োগ, এবং গুরুত্বপূর্ণ ওষুধের মাত্রা পরিবর্তন করে হঠাৎ শারীরিক পতন ঘটানো ছিল তার অপরাধের কৌশল। এই সব অপরাধ দীর্ঘ সময় ধরে হাসপাতালে ঘটলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা সঠিকভাবে মূল্যায়ন কিংবা রিপোর্ট করতে ব্যর্থ হয়, যার জন্য অনেক শিশুর জীবন অকালে থেমে যায়।
তদন্তে উঠে এসেছে, শিশুমৃত্যুর ধরণ সন্দেহজনক হলেও লেটবিকে বারবার সহানুভূতির চোখে দেখা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনের পরিবর্তে কর্তৃপক্ষ তাকে আরও দায়িত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছে। এখন গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক তিন কর্মকর্তা এই ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরাসরি জড়িত ছিলেন বলেই সন্দেহ করা হচ্ছে।
এদিকে, তদন্ত চলাকালে লেটবির আইনি দল দাবি করেছে যে নবজাতক ইউনিটে চিকিৎসার ঘাটতি, দুর্বল তত্ত্বাবধান এবং প্রাকৃতিক কারণই মৃত্যুগুলোর পেছনে দায়ী। এই দাবি তারা আন্তর্জাতিক চিকিৎসকদের মতামতের ভিত্তিতে দাখিল করেছে, যা বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ফৌজদারি মামলা পর্যালোচনা কমিশন (CCRC) মূল্যায়ন করছে।
তবে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর আইনজীবীরা এই দাবিকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা বলছেন, এটি কেবলমাত্র পূর্ববর্তী বিচারকার্যের প্রতিরক্ষা যুক্তির পুনরাবৃত্তি, যার কোনো ভিত্তি নেই। বরং তারা দাবি জানিয়েছেন, হাসপাতালের অবহেলা ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা নিয়ে স্বাধীন, খোলামেলা, এবং পূর্ণাঙ্গ একটি পাবলিক তদন্ত সম্পন্ন হোক। লেটবির ব্যারিস্টার মার্ক ম্যাকডোনাল্ডও একই দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছেন—একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত যেন হাসপাতালের “ব্যর্থতা” স্পষ্টভাবে জনগণের সামনে উন্মোচিত করতে পারে।
অন্যদিকে, চেশায়ার পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা ডিট. সুপারিনটেনডেন্ট হিউজেস এই গ্রেপ্তারের পর মন্তব্য করেন, “এটি লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে এই গ্রেপ্তারগুলো লুসি লেটবির বিরুদ্ধে পূর্ববর্তী খুন ও খুনের চেষ্টার অভিযোগের উপর কোনও প্রভাব ফেলবে না।” তার বক্তব্যে বোঝা যায়, এই তদন্তের লক্ষ্য এখন মূল অপরাধীর পাশাপাশি সেই ব্যবস্থাগত অবহেলার দিকেও, যা তাকে এত বড় অপরাধ করতে পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে।
এই তদন্ত যতই গভীর হচ্ছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে যে একটি নার্সের ভয়ঙ্কর আচরণ শুধুমাত্র তার ব্যক্তিগত মনোবৈকল্য নয়, বরং একটি বৃহৎ সিস্টেমিক ব্যর্থতার প্রতিফলনও বটে। ব্রিটেনের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, চিকিৎসা তত্ত্বাবধান, এবং প্রশাসনিক জবাবদিহিতার প্রশ্ন আবারও সামনে উঠে এসেছে।
এই মুহূর্তে গোটা বিশ্ব অপেক্ষা করছে আগামী বছরের সেই চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনটির জন্য, যা হয়ত স্পষ্ট করে দেবে—একটি আধুনিক, উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে কীভাবে একজন খুনি নার্স বছরের পর বছর তার ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যেতে পেরেছিলেন এবং সেই অপরাধ ঠেকাতে কতটা ব্যর্থ হয়েছিল একটি হাসপাতাল, একটি সিস্টেম।
এ যেন কেবল একটি অপরাধের তদন্ত নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি সতর্কবার্তা—গাফিলতির ছায়া যতই গভীর হোক, সত্য একদিন আলো দেখবেই।








