শিরোনাম :
শেখ হাসিনার বিচার শুরু হয়েছে, দলীয়ভাবেও আওয়ামী লীগের বিচার হওয়া উচিত: মির্জা ফখরুল উত্তরের অচেনা বিস্ফোরণ: লেবাননে ইসরাইলি ড্রোন হামলায় নিহত ৩, আহত ১৩ কারামুক্তির পর পর্দায় ফেরার বার্তা: ‘জ্বীন-৩’ দিয়ে ফিরলেন নুসরাত ফারিয়া জামায়াতের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ চীন সফরে জাতীয় সমাবেশে জামায়াতের বার্তা: ৭ দফা দাবিতে বড় গণসমাবেশের প্রস্তুতি বাস রুট পারমিট নিয়ে ঢাকার পরিবহন খাতে অস্থিরতা, সিদ্ধান্তহীনতায় আরটিসি বরিশালে টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা, অচল জনজীবন নিঃসঙ্গ জীবনের করুণ পরিণতি: পাকিস্তানে অভিনেত্রী হুমাইরা আসগরের পচনধরা লাশ উদ্ধার ব্যাটিং বিপর্যয়ে সিরিজ হাতছাড়া, হতাশ মিরাজ জানালেন ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা পুনরায় মহাসংঘর্ষ: রিয়াল-পিএসজির দ্বৈরথে আজ ইতিহাস লিখবে কে?

‘ক্ষমা চাই, তবে ধাপে ধাপে বদল—’ টকশোতে জামায়াত আমীরের ঘোষণা ঘিরে নতুন বিতর্ক, গণতন্ত্র-শরিয়াহ সহাবস্থানের রূপরেখা কতটা বাস্তব?

আজকের খবর ডেস্ক
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন, ২০২৫
  • ১৩৩ বার

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫ | আজকের খবর ডেস্ক | আজকের খবর অনলাইন

রাত আড়াইটার বেইজিং-ঢাকা ফ্লাইটের মতোই বাংলাদেশের অনলাইন পরিমণ্ডলে গতকাল ঝড় তুলেছিল নিউইয়র্কভিত্তিক টকশো ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’। বিশিষ্ট সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীনের মুখোমুখি হয়েছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান। প্রায় এক ঘণ্টার সেই আলাপচারিতায় তিনি যে তিনটি কেন্দ্রীয় বক্তব্য রেখেছেন—(১) ১৯৪৭-৭১-সহ যে-কোনো সময়ে জামায়াতের কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলে ‘নির্বিশেষে ক্ষমা চাই’, (২) গণতন্ত্রকে ‘কোনো মতবাদ নয়, বরং পছন্দের আদর্শ প্রতিষ্ঠার বাহন’ বলে স্বীকার, এবং (৩) কুরআন-সুন্নাহ-সামঞ্জস্য রক্ষায় ধীরে-ধীরে সংবিধান সংশোধনের কথা—সেগুলো মুহূর্তেই সামাজিক মাধ্যম ছাপিয়ে মূলধারার আলোচনায় ঢুকে পড়েছে।

ডা. শফিকুর রহমানের কথায়, “শুধু ১৯৭১ নয়, ১৯৪৭ থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের দ্বারা কেউ আঘাত পেয়ে থাকলে বিনা শর্তে ক্ষমা চাই।” এই ঘোষণাকে অনেকে দেখছেন দলটির ৭০-বছর ধরে গায়ে লাগা যুদ্ধাপরাধ-সহ ‘জনবিচ্ছিন্নতার’ তকমা ঝেড়ে ফেলার প্রচেষ্টা হিসেবে। নিউইয়র্ক থেকে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানটি সরাসরি দলে-মহলে ‘ঐতিহাসিক’ বলে ঘোষিত হলেও, দেশের বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি একে ‘অপর্যাপ্ত ও অস্পষ্ট’ ভাষ্য হিসেবে নাকচ করেছে । তারা প্রশ্ন তুলছে—ক্ষমার পূর্বশর্ত হিসেবে ‘সুনির্দিষ্ট অপরাধ-স্বীকৃতি’ না থাকলে এ নিছক কৌশলগত কূটকৌশল নয় কি?

বিগত আট মাসে এটি তাঁর দ্বিতীয়বারকার ‘ক্ষমার কথা’ উচ্চারণ। গত মে মাসে ঢাকায় এক প্রেস ব্রিফিংয়েও তিনি অনুরূপ বক্তব্য দিয়েছিলেন । সে সময়ও সমালোচকেরা বলেছিলেন—ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিত নেতাদের বিষয়ে সরাসরি শব্দ না এলে ‘ক্ষমা-বক্তব্য’ পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না।

টকশোতে ডা. শফিকুর রহমান গণতন্ত্রকে বর্ণনা করেন “ইটস এ ওয়ে টু এস্ট্যাবলিশ ইওর ইজম”—অর্থাৎ ব্যক্তিগত বা দলীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য এটি কেবলই পরিবহণ। তাঁর মতে, কেউ সমাজতন্ত্র, কেউ পুঁজিবাদ, আবার কেউ ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা বেছে নিতে পারে; গণতন্ত্র সে পছন্দ বাস্তবায়নের পথমাত্র। তাঁর এই ‘বাহন-তত্ত্ব’কে বৈশ্বিক ইসলামি রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ‘মধ্যপন্থা’ বলে প্রশংসা করেছে দলীয় সমর্থকেরা, আর বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষ শিবির বলছে—এটিই প্রমাণ করে জামায়াত গণতান্ত্রিক কাঠামোকে কেবল ‘পাওয়ার-মেকানিজম’ হিসেবে দেখে, মূল্যবাদী বিশ্বদর্শন হিসেবে নয়।

সংবিধানের ধারাগুলোর সঙ্গে কুরআনি বিধানের সংঘাত হলে কী হবে—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “অনেক ধারাই কুরআনের সঙ্গে মিলে যায়; বিরোধ যেগুলো, তা সমাজকে সম্পৃক্ত করে পর্বক্রমে সমাধান করব।” উদাহরণ টেনে বলেন, মদ নিষিদ্ধ হওয়ার কুরআনি প্রক্রিয়াও তিন ধাপে সম্পন্ন; ইসলামি শাসন চাপিয়ে নয়, ধাপে ধাপে প্রতিষ্ঠিত হয়।

জামায়াত-বিরোধী ২০১৩-এর হাই কোর্ট রায় প্রায় এক যুগ ধরে দলটিকে নির্বাচনী রাজনীতির বাইরে রেখেছিল । কিন্তু চলতি মাসের শুরুতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে দলটিকে পুনরায় নিবন্ধন ফিরিয়ে দিতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে । ফলে ২০২৬ সালের ভোরের আগেই জাতীয় নির্বাচন ঘিরে দলটি ফের চালচিত্রে উঠে আসছে। এ প্রেক্ষাপটে ক্ষমা-ঘোষণা ও ‘গণতন্ত্র-সমন্বয়’-বক্তব্যকে অনেক পর্যবেক্ষক দেখছেন ভোটমুখী পুনর্ব্র্যান্ডিং কৌশল হিসেবে।

মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গণহত্যা মামলায় স্বজন হারানো পরিবারগুলো ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্যকে “অস্পষ্ট ও এড়ানোর চেষ্টামূলক” বলে মন্তব্য করেছে। তাঁদের যুক্তি—যদি ‘অন্যায়’ শব্দে ১৯৭১-এর ধর্ষণ, গণহত্যা, নির্যাতন ঢেকে দেওয়া হয়, তবে তা বিচারবহির্ভূত ইতিহাস-ধোলাই হবে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বলছে—ক্ষমা হতে হবে অপরাধ-স্বীকৃতি, ক্ষতিপূরণ পরিকল্পনা ও সত্য-কমিশনের রূপরেখাসহ; নইলে ক্ষমা ভাষণে ন্যায়বিচারকে পাশ কাটানোই হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, দক্ষিণ এশিয়ার ইসলামি দলগুলো গত এক দশকে আরব বসন্ত-উত্তর বাস্তবতায় গণতন্ত্রকে ‘হালাল বাহন’ হিসেবে পুনরাবিষ্কার করেছে। জামায়াত আমীরের কথায় সেই প্রবণতার স্পষ্ট ছাপ। অন্যদিকে, তাঁর অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জও কম নয়—গভীরে গেঁথে থাকা যুদ্ধাপরাধ-মিরায, উগ্র ছাত্রসংগঠনের সহিংস পরিচিতি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘রাজাকার’ তকমা। ক্ষমা-বক্তব্য নিশ্চয়তা দেবে কি, নাকি অর্ধ-স্বীকারোক্তির ফাঁদে দলটিকে আটকে রাখবে—তা সময়ই বলবে।

টকশো শেষে নেটমাধ্যমে ছিল দুই মেরুর প্রতিক্রিয়া—একদল বলছে “এটাই ঐতিহাসিক মুহূর্ত”, আরেকদল বলছে “গণতান্ত্রিক সরলীকরণের আড়ালে অপরাধ-ধোয়া”। তবু এ কথা অনস্বীকার্য, জামায়াত-ইস্যুতে জাতীয় সংলাপ বহুদিন পর আবার ‘ক্ষমা’ শব্দে ফিরেছে। যদি সত্যিই “ইন্টারএক্টিভ প্রসেস” আর “ধাপে ধাপে সংস্কার” বাস্তব পদক্ষেপে রূপ নেয়, তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভূচিত্রে এটি হতে পারে এক নতুন পরীক্ষা। কিন্তু সে পরীক্ষার উত্তরে ইতিহাসের রক্তাক্ত অধ্যায়গুলো কতটা স্বচ্ছভাবে পাঠ করা হবে, সেটিই হয়তো বিচার করবে ক্ষমাপ্রার্থনার প্রকৃত মানে।

আর যদি ক্ষমাপ্রার্থনার পরও ইতিহাসের নির্দিষ্ট সত্যগুলো অস্বীকার, বিকৃতি কিংবা এড়িয়ে যাওয়া চলতেই থাকে, তবে ক্ষমা-ঘোষণা থেকে যে ‘আশা’র সূত্রপাত, তা রয়ে যাবে কথার আড়াইতলা ভবনেই—ভবিষ্যতের প্রজন্ম জানতেও পারবে না, সেই ভবনের ভিত্তিপ্রস্তরে ছিল ন্যায়বিচারের অপূর্ণ দাবি।

এ মুহূর্তে therefore, ‘ক্ষমা-ঘোষণা’ রাজনীতিতে একটি নতুন জানালা খুলেছে—কিন্তু জানালার ফাঁক দিয়ে যদি আলো না ঢোকে, তবে তা কেবলই শব্দের পর্দা, ইতিহাসের না-মোছা কালির উপরে আরেকটি দস্তাবেজ মাত্র।

নিউজটি শেয়ার করুন..

এ জাতীয় আরো খবর..

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২৫